বুধবার ৩ জুলাই ২০২৪
প্রচার-পদক-সম্মাননা বনাম সৃষ্টিশীলতা
মনিরুল ইসলাম শ্রাবণ
প্রকাশ: শনিবার, ২২ জুন, ২০২৪, ৩:০৮ PM
অল্পতে আত্মতুষ্টি সম্পদে ভালো, সাহিত্যে ভালো নয়। সাহিত্যে অল্পতে আত্মতুষ্ট হওয়ার কোনো সুযোগ নেই। আজকাল দেখা যায় আমরা অল্পতেই সন্তুষ্ট হয়ে উঠি। কিছু একটা লিখেই মনে করি মহা কিছু লিখে ফেললাম। এবার যুগ যুগ ধরে মানুষ আমাকে স্মরণ করবে। বিষয়টি তা নয়। আজকে যেই লেখাটি প্রচুর জনপ্রিয় এবং প্রাসঙ্গিক, সময়ের সাথে সেই লেখাটি তার জনপ্রিয়তা হারাতে পারে। আবার আজকে একটি অখ্যাত, অপ্রাসঙ্গিক লেখা সময়ের সঙ্গে খুব বেশি প্রাসঙ্গিক ও জনপ্রিয় হয়ে উঠতে পারে। কাজেই একজন লেখককে তার পুরো জীবনে সাহিত্য সাধনায় এই জন্যই যুক্ত থাকতে হয় কারণ তিনি জানেন না যে, তার কোন সৃষ্টি যুগ যুগ ধরে টিকে থাকবে আর কোনটি থাকবে না। তাই একজন লেখক আজীবন একটি সঠিক লেখার জন্য চেষ্টা করে থাকেন। কেবল এভাবেই একজন লেখক তার লেখক জীবনের পূর্ণতা অর্জন করতে পারেন। উপরিউক্ত বক্তব্যটি তাদের জন্য প্রযোজ্য যারা মানসম্মত কিছু লিখেন।

মানহীন লেখা সাহিত্যের আবর্জনা মাত্র। সময় একদিন তার ডাস্টবিনে এই মানহীন লেখাগুলোকে ছুড়ে ফেলে দেবে। কাজেই সাহিত্যে টিকে থাকার জন্য প্রচারের চেয়ে সৃষ্টিশীলতায় বেশি মনোযোগী হওয়া উচিত। আজকাল কিছু মানুষ নিজের আত্মপ্রচারে যে সময় এবং শ্রম ব্যয় করেন এই সময়, মেধা ও শ্রম যদি সৃষ্টিশীল, সৃজনশীল কাজে ব্যয় করতেন তাহলে মানুষই তার সৃষ্টি প্রচার করতো এবং দীর্ঘদিন তাকে মনেও রাখতো। আজ না হয় কেউ জীবিত আছেন বলেই নিজেকে আলোচনায় রাখতে তিনি নানা চেষ্টা, তদবির করছেন। কিন্তু তার চোখের আলো নিভে গেলে তিনিও একদিন হারিয়ে যাবেন, যদি তিনি সৃষ্টিশীল/সৃজনশীল কিছু কাজ না করে যান।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, জীবনানন্দ দাশ, জসীমউদ্দীন বা শামসুর রাহমান- তারা কেউ ফেসবুক, টুইটার ব্যবহার করেননি। তাদের সময়ে ওয়েবসাইট, অনলাইন পত্রিকাও ছিল না। তারা নিজেদের বইয়ের বহু বহু কপি প্রকাশ করে যেতে পারেননি। তাদের লেখা রেডিও, টিভি বা ছাপা পত্রিকায় এখনকার মতো বহুল প্রচারের সুযোগ পায়নি। কিন্তু তা সত্ত্বেও আজও তারা মানুষের মাঝে বেঁচে আছেন। তাদের নিয়ে আলোচনা হয়। তাদের সাহিত্যকর্ম পঠন-পাঠন হয়। তাদের লেখার নির্যাস নিয়েই এখনো নতুন নতুন সাহিত্য রচিত হয়। আধুনিক যুগের তৈরি করা সকল প্রচার মাধ্যমে তারা আপনার আমার নামের চাইতেও বেশি লিখিত এবং উচ্চারিত হন। এটা শুধু সম্ভব হয়েছে তাদের অসাধারণ মেধা, প্রতিভা ও সৃষ্টিশীল কাজগুলোর জন্য। তারা প্রচারে নয়, সৃষ্টিতে সময় ব্যয় করেছেন। আপনার, আমার মত এত প্রচার প্রিয় হলে তারা কিন্তু এসব সৃষ্টি করতে পারতেন না।

আমাদের কথা মনে রাখতে হবে- মুরগি ছোট্ট একটি ডিম পেড়ে সারা পাড়া মাতিয়ে রাখে। অপরদিকে বাঘ, সিংহ বা হাতি তাদের বৃহৎ আকারের বাচ্চা জন্ম দিয়ে কোনো সাড়া শব্দ করে না। এই বাচ্চাগুলোই বড় হয়ে পুরো বন দাঁপিয়ে বেড়ায়, ভীত-তটস্থ করে রাখে। কুকুর, বিড়াল ঘন ঘন বাচ্চা প্রসব করে, কিন্তু তার কয়টায় বাচ্চা টিকে থাকে? তাই চট করে কিছু একটা লিখে তা নিয়ে হইচই করার কিছু নেই। আপনি ভালো কিছু লিখলে সময়ের সাথে তা অবশ্যই জনপ্রিয় হবে। কাজেই এইসব পদক-সম্মাননার পেছনে না ছুটে আমাদের সৃজনশীল কাজে মনোযোগী হওয়া উচিত।

একটি গাড়ির গতি যত বেশি হবে তার চালিকাশক্তি বা ইঞ্জিন বন্ধ করার পরেও আরো বেশ কিছু দূর এগিয়ে যায়। আপনি থামার পর বা মৃত্যুর পর আপনার সাহিত্যকর্ম কত বেশি সামনে এগিয়ে যেতে পারবে তা নির্ভর করবে আপনার লেখার মানের ওপর। অর্থাৎ কোনো লেখার মানই সেই লেখার গতি। এই মানসম্মত লেখা কিন্তু চট করে, হুটহাট করে আসে না। অনেকেই বলেন- একটি লেখা লেখার পরে তা বেশ কিছুদিন ফেলে রাখা উচিত এবং পরবর্তীতে আবার সেটি পড়ে সংশোধন করে নেওয়া উচিত। শুধু একবার নয় বারবার এই কাজটি করলে একটি মানসম্মত লেখা তৈরি হয়। অর্থাৎ একটি লেখার জন্মের পরে অন্তত ছয় মাস থেকে এক বছর অপেক্ষা করলেইি একটি মানসম্মত লেখা পাঠকদের উপহার দেওয়া সম্ভব। যা আমরা কেউ করি না।

বর্তমানে প্রচার মাধ্যম সহজ হওয়ায় লেখার সাথে সাথে পোস্ট করার মানসিকতা আমাদের প্রায় সবারই রয়েছে। এছাড়া এখন অনলাইন/অফলাইনসহ প্রকাশ করার ক্ষেত্রেও অনেক। তাই কিছু লিখেই আমরা চট করে সেটা প্রকাশে উদ্যোগী হয়ে যাই। আর একবার প্রকাশ হয়ে গেলে সেই লেখাটিকে দ্বিতীয়বার আর ঘষামাজার চেষ্টা করি না; যা আমাদের মানসম্মত লেখার অন্যতম প্রতিবন্ধকতা বলে আমি মনে করি।

আর পদক, পুরস্কার বা সম্মাননার কথায় বলতে হয়- আপনি জীবদ্দশায় যত বড় পদকই পান না কেন, সেটা নোবেল বা বুকার হোক না কেন, তা আপনার প্রকৃত মূল্যায়ন নয়। আপনার মৃত্যুর পর যদি কোনো সম্মান বা পদক পান সেটাই হবে আপনার প্রকৃত মূল্যায়ন। কেননা জীবদ্দশায় এই সম্মান পদক পাওয়ার জন্য আপনার সামান্য হলেও চেষ্টা, তদবির মেকানিজম থাকে, কিন্তু মৃত্যুর পর তার বিন্দুমাত্র থাকে না। মৃত্যুর পরে যে সম্মাননা আপনি পাবেন তা আপনার কর্মগুণেই পাবেন। কাজেই সেটিই হবে আপনার প্রকৃত সম্মাননা। রবীন্দ্রনাথ নোবেল পেয়েছেন কিন্তু তার জনপ্রিয়তা নোবেল পাওয়ার জন্য নয়, তাদের সৃষ্টিশীল কাজের জন্য। নজরুল, জীবনানন্দ, শামসুর রাহমান, জসীম উদ্দীনেরা নোবেল না পেয়েও জনপ্রিয় এবং আজও তারা স্বীয় আলোতে দীপ্তমান, তাও কিন্তু ওই সৃষ্টিশীল কাজের জন্যই। কাজেই প্রচারে নয়, সৃষ্টিতে মনোযোগী হোন। সৃষ্টিশীলতার উল্লাসে মেতে উঠুন। সৃষ্টি সুখের উল্লাসে মেতে উঠুন।

মানসম্মত সাহিত্য সৃষ্টির আরেকটি প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে তথাকথিত অনলাইন গ্রুপগুলো। অনলাইন গ্রুপগুলো একদিকে লেখক-পাঠক তৈরি এবং প্রচারে ভূমিকা রাখলেও এর ব্যাপক ব্যবহার মানসম্মত লেখা তৈরিতে বাধা সৃষ্টি করছে। তথাকথিত দৈনিক সেরা কবিতা, সাপ্তাহিক সেরা কবিতা, মাসিক সেরা কবিতা নির্বাচিত করা এবং তার জন্য সম্মাননা স্মারক, সনদ ও পদক প্রদান করা। অনুষ্ঠানে আয়োজন করে পদক-সম্মাননা স্মারক, সনদ গ্রহণ একজন লেখকের কাজে প্রতিবন্ধকতা ছাড়া আর কিছুই নয়।

মোবাইল ফোন, কম্পিউটারে বানানো পদক, সম্মাননা দেখে আমি, আপনি খুশিতে গদ গদ হতে পারেন, এগুলো দিয়ে আপনি সাময়িক সময়ের জন্য খ্যাতিও পেতে পারেন, কিন্তু তা আপনাকে চির অমর করে রাখবে না। একবার ভেবে দেখুনতো- এই যে আপনি পদক/সম্মাননা পেয়েছেন বলে যে এতো প্রচার করছেন, বলুনতো আপনার কোন লেখাটি দেশজুড়ে পাঠকের মাঝে আলোচনা/সমালোচনা সৃষ্টি করেছে। বলুনতো আপনার কোন বইটি লেখক/পাঠকের কাছে ব্যাপক সমাদৃত হয়েছে। তা যদি না হয়ে থাকে তাহলে আপনার পদক/সম্মাননা ভণিতা নয় কি?

তাছাড়া আপনি আপনার লেখাকে কেন প্রতিযোগিতার জন্য ছেড়ে দিবেন। প্রত্যেকের লেখা যদি একই ধরনের হয় তাহলে তার সেটা লেখা হলো না। প্রতিযোগিতা সাধারণত একটি নির্ধারিত নিয়ম মেনে হয়। যেখানে সব প্রতিযোগী সমান সুযোগপ্রাপ্ত হয় এবং নির্ধারিত নিয়মে এগিয়ে যায়। মৌলিক সাহিত্য সৃষ্টিতে এই নিয়মটি একদম বেমানান। এ কারণে সাহিত্য প্রতিযোগিতা বা অনলাইন প্রতিযোগিতা আমার কাছে হাস্যকর মনে হয়। প্রতিটি লেখক ও তার প্রতিটি সাহিত্যকর্ম আলাদা আলাদা জ্যোতিতে দীপ্তিমান। এই জ্যোতি সৃষ্টি ও ধরে রাখাই একজন লেখকের মূল কাজ।

আজকালের খবর/আরইউ








সর্বশেষ সংবাদ
৬০৯ কোটি টাকার এলএনজি কিনছে সরকার
তিস্তা চুক্তি হবে আন্তর্জাতিক নদী আইন মেনে: নজরুল
তাসকিন বললেন, ‘বেশিরভাগ সংবাদ এবং তথ্য গুজব’
ইসরায়েলের নতুন আদেশ নিয়ে জাতিসংঘের উদ্বেগ
নির্বাচন কমিশনের মামলায় খালাস পেলেন ইমরান খান
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
চোখ রাঙাচ্ছে বন্যা, সিলেটসহ পাঁচ জেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত
নাটোর জেলা বিএনপির আহ্বায়ককে কুপিয়ে জখম, সাবেক মেয়রসহ আহত ৭
শাহজালাল বিমানবন্দরে সাড়ে ৪ কোটি টাকার সোনা জব্দ
যুক্তরাজ্যে নির্বাচন আগামীকাল, লড়াই করছেন ৩৪ বাংলাদেশি
কর্মবিরতিতে অচল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, অর্থমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি
Follow Us
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি : গোলাম মোস্তফা || সম্পাদক : ফারুক আহমেদ তালুকদার
সম্পাদকীয়, বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : হাউস নং ৩৯ (৫ম তলা), রোড নং ১৭/এ, ব্লক: ই, বনানী, ঢাকা-১২১৩।
ফোন: +৮৮-০২-৪৮৮১১৮৩১-৪, বিজ্ঞাপন : ০১৭০৯৯৯৭৪৯৯, সার্কুলেশন : ০১৭০৯৯৯৭৪৯৮, ই-মেইল : বার্তা বিভাগ- newsajkalerkhobor@gmail.com বিজ্ঞাপন- addajkalerkhobor@gmail.com
কপিরাইট © আজকালের খবর সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত | Developed By: i2soft