বুধবার ৩ জুলাই ২০২৪
মানিক মাস্টার
ফারুক আহম্মেদ জীবন
প্রকাশ: শনিবার, ২২ জুন, ২০২৪, ৩:০৪ PM আপডেট: ২২.০৬.২০২৪ ৩:১১ PM
যশোর ঝিকরগাছার পার্শ্ববর্তী শান্তিপুর গাঁয়ের সরকারি প্রাইমারি স্কুলের প্রধান শিক্ষক মানিক মিয়া। যিনি মানিক মাস্টার নামেই আশপাশের দু-দশ গ্রামের মানুষের কাছে সুপরিচিত। মানিক মাস্টার যেমন অমায়িক, তেমন তার সুমিষ্ট পূর্ণ মার্জিত ব্যবহার। তার মহত্ত্ব আর মানবিকতার জন্য এলাকার সকলের কাছে তিনি অতি প্রিয়। ছোট ছোট বাচ্চাকাচ্চা থেকে শুরু করে তার সমবয়সী এমনকি বয়োঃবৃদ্ধ যতো নারী পুরুষ সকলে তাকে দেখলে যেমন সালাম দেয়। তেমনি করে সম্মান ভক্তি আর শ্রদ্ধা।  
মানিক মাস্টারের সভ্য সুলভ ভদ্র আচরণের জন্য, আর স্কুলের সব ছাত্র-ছাত্রীদের সাথে সমান উত্তম ব্যবহারের জন্য আজ সে সকলের কাছে এতো সম্মানের পাত্র হয়ে উঠেছে। তিনি-যে শুধু আদর্শবান তা নয়। পাশাপাশি সে অনেক গুণেরও অধিকারী। তার মনটা খুবি নরম। দয়া, মায়া, মমতায় যেনো তার মন পরিপূর্ণ।
দিনি যেমন এলাকার কোনো মানুষদের বিপদ-আপদ দেখলে স্থির থাকতে পারেন না। পাশে গিয়ে দাঁড়ান। তার সাধ্যমতো সাহায্য সহযোগিতা করেন। তেমন স্কুলের কোনো অসহায় গরীব ছাত্র-ছাত্রী থাকলে, যারা টাকার অভাবে বই খাতা কলম কিনতে পারে না। তিনি তার স্কুলের নিজের বেতনের টাকা দিয়ে গরিব ছাত্র- ছাত্রীদের বই, খাতা কলম কিনে দেন।
শান্তিপুর গাঁয়ের এক গ্রাম পর সখিপুর গাঁয়ে তার বাড়ি। তিনি এই স্কুলে শিক্ষকতা করছেন তা- প্রায় এক যুগ পার হয়ে গেছে। এরইমধ্যে দুই তিন বার তার অন্য স্কুলে বদলির অর্ডার এসেছে। কিন্তু এলাকার মানুষেরা মানিক মাস্টারকে এতোটাই ভালোবাসে যে, যখনি বদলির অর্ডার আসে, তখনি এলাকার সকল মানুষজন সম্মিলিতভাবে চেয়ারম্যান-মেম্বারদের ধরে উপজেলার শিক্ষা অফিসে হাজির হয়ে দরখাস্ত দিয়ে বদলি বাতিল করে দেয়। মানিক মাস্টারের সদাচরণ, আর তার মানবিকতার জন্য তার প্রতি মানুষের ভালোবাসার কথা; নিজ এলাকার আঞ্চলিক পেপার-পত্রিকা-সহ দেশের জাতীয় পত্রিকাগুলো এমনকি বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি মিডিয়া চ্যানেলগুলোতেও ছড়িয়ে পড়েছে। এ বিষয় নিয়ে মানিক মাস্টারের সাথে মিডিয়ার সাংবাদিকেরা কথা বলতে গেলেন। মানিক মাস্টার বলেন আমি নিজের নাম ছড়ানোর জন্য এগুলো করিনি বিশ্বাস করুন। আমি যেটি করি, সেটি শুধু মাত্র আমি আমার নিজের মনুষ্যত্ব আর বিবেকের তাড়নায় মানবিকতা থেকে করি। আমি প্রিয় জাতীয় কবি, কাজী নজরুল ইসলামের ওই কথায় বিশ্বাসী যে... ‘যখন তুমি এসেছিলে ভবে,/কেঁদেছিলে তুমি হেসেছিল সবে।/এমন জীবন তুমি করিও গঠন,/মরণে হাসিবে তুমি কাঁদিবে ভুবন।’ চিরস্থায়ী ভাবে সারাজীবন আমি এ ভুবনে বেঁচে থাকবো না। তাই যেটুকু সময় বেঁচে থাকি। আমি আমার জীবনটাকে স্রষ্টার সকল সৃষ্টির কল্যাণে উৎসর্গ করতে চাই।
আজ মানিক মাস্টার স্কুলে যাওয়ার পর থ্রির ক্লাসরুমে গেলেন। সকল ছাত্র- ছাত্রী দাঁড়িয়ে সমবেত কণ্ঠে স্যারকে সালাম দিলো। মাস্টার সালামের উত্তর দিয়ে চেয়ারে বসে সকলের ভালো মন্দ কুশলাদি জিজ্ঞাসা করলেন। সকলে বললো জ্বি স্যার, আমরা ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন স্যার? মানিক মাস্টার উত্তরে বললেন আলহামদুলিল্লাহ আমিও ভালো আছি।
তারপর মানিক মাস্টার হাজিরা খাতা বের করে প্রথম থেকে এক-এক করে ছাত্র-ছাত্রীদের নাম ডাকতে লাগলেন। সকলে উপস্থিত স্যার বলে সাড়া দিতে লাগলো। একসময় মানিক মাস্টার বললেন রোল নম্বর নয়, কোনো সাড়া নেই। আবারো বললেন রোল নম্বর নয়, বাসন্তী আক্তার। তবু কোনো সাড়া নেই। কোনো সাড়া না পেয়ে শেষে সামনের দিকে তাকালেন মানিক মাস্টার। কোথাও বাসন্তীকে দেখতে পেলেন না। ওই ক্লাসের মেঘলার বাড়ি বাসন্তীদের পাড়ায়। মানিক মাস্টার তখন মেঘলার কাছে জিজ্ঞাসা করলেন মেঘলা...বাসন্তী স্কুলে আসেনি কেনো তুমি কি জান? আজ বেশ কয়েকদিন তাকে স্কুলে দেখছি না। মেঘলা বললো স্যার, আমি গতকাল বেড়াতে বেড়াতে ওদের বাড়ি গিয়েছিলাম। গিয়ে দেখি বাসন্তী খুব অসুস্থ। প্রচণ্ড জ্বর বাসন্তীর গায়ে। জ্বরের চোটে বাসন্তী কাঁপছিল বারান্দায় শুয়ে। আর ওর মা, ওর মাথায় জল দিচ্ছিলো। শুনে মানিক মাস্টার বললেন সেকি! একথা আমাকে আগে বলোনি কেন? মেঘলা বললো, বলতে চেয়েছিলাম কিন্তু আমার মনে ছিলো না স্যার। ওইদিন ক্লাস শেষে স্কুল ছুটির পর। মানিক মাস্টার বাসন্তীকে দেখার জন্য গাঁয়ের বাজার থেকে কিছু ফলমূল কিনেন। বাসন্তীদের বাড়ির উদ্দেশ্য সাইকেল চড়ে রওনা দিলেন। পথে যাওয়ার সময় মানিক মাস্টারকে দেখে অনেকে সালাম দিয়ে ভালোমন্দ জিজ্ঞাসা করতে লাগলো।
মানিক মাস্টারও। সকলকে উত্তর দিতে দিতে সামনের দিকে এগুতে লাগলেন। একসময় পৌঁছে গেলেন বাসন্তীদের বাড়ির উঠানে। বাসন্তীর মা মানিক মাস্টারকে দেখতে পেয়ে বাসন্তীকে বললো, মা বাসন্তী ওই দেখ তোমার স্কুলের স্যার এসেছে তোমাকে দেখতে। তারপর সালাম দিয়ে ভালোমন্দ জিজ্ঞাসা করে বসতে দেওয়ার জন্য ঘর থেকে একটা চেয়ার এনে দিলো। স্যারকে দেখে বাসন্তী শোয়া থেকে উঠে বসার চেষ্টা করলো। মানিক মাস্টার বললো, থাক দুর্বল দেহে তোমাকে উঠতে হবে না বাসন্তী মা। তুমি শুয়ে থাকো। তারপর ফলগুলো বাসন্তীকে খেতে বলে তার মাথার কাছে রাখলেন। একসময় বাসন্তীর মাকে জিজ্ঞাসা করলো জ্বর কতোদিন হয়েছে? বাসন্তীর মা বললো তা- প্রায় এক সপ্তাহ হয়েছে গেছে মাস্টার। ওষুধ খাওয়ালে জ্বর কমছে আবার বাড়ছে। কিন্তু নির্মূল হচ্ছে না। গাঁয়ের ডাক্তার পরীক্ষা করাতে বলছে। কিন্তু টাকার অভাবে নিয়ে যেতে পারছি না। সবকিছু শুনে মানিক মাস্টার বুঝতে পারলেন এটি ডেঙ্গু জ্বরে লক্ষণ। খেয়াল করলের বাসন্তীদের বাড়ির আশপাশে বেশ ঝোপ-ঝাড় আর ময়লা অপরিষ্কার। আবার উঠানের এক কোণে দেখলো লেবুতলায় একটা ছোট গর্তে টিউবওয়েলের নিষ্কাশিত হাঁড়িকুঁড়ি, থালাবাসন  ধোয়ার জমা বদ্ধ জল। সে বাসন্তীর মা-বাবাকে ওইসব দেখিয়ে বললো, এমন অপরিষ্কার অপরিচ্ছন্ন পরিবেশে ডেঙ্গু মশারা ডিম পেড়ে বংশবিস্তার করে। তারপর বাসন্তীর বাবা-মাকে সবকিছু বুঝিয়ে বলে বাড়ির আশপাশ ও কুয়ার বদ্ধ জল পরিস্কার করার কথা বললেন। আর আগামীকাল স্কুলে ছুটির দিন। তাই বাসন্তীকে ডেঙ্গু পরিক্ষার জন্য শহরে ক্লিনিকে নিতে বললেন। আরো বললেন তিনি নিজেও তাদের সাথে যাবেন। আর পরীক্ষা-নিরীক্ষার কিম্বা যাতায়াত ওষুধ পথ্যের খরচের জন্য চিন্তা করতে হবে না।
সব খরচ সে নিজে বহন করবে। শুনে তো আশ্বস্ত হলো ছাপোষা হতদরিদ্র অভাবী গরীব মানুষ সলিম মিয়া, আর স্ত্রী সখিনা বিবি। যে-কথা সেই কাজ, তার পরদিন সকালে বাসন্তীকে নিয়ে শহরে পরীক্ষা করে দেখা গেলো সত্যি ডেঙ্গু পজিটিভ। বাসন্তীর মা-বাবা শুনে খুব ভয় পেলো। ডাক্তার বললেন, এখন ডেঙ্গু নিয়ে ভয়ের কিছু নেই। আমি ে ওষুধ ইনজেকশন লিখে দিচ্ছি তা- নিয়মিত ব্যবহার করবেন। আর বেশি বেশি ডাবের জল খাওয়াবেন। দেখবেন অল্পদিনের মধ্যে আপনার মেয়ে সুস্থ হয়ে উঠবে। মানিক মাস্টার ওষুধ-পথ্য ইনজেকশন তার সাথে আরো কিছু ফলমূল কিনে দিয়ে বাসন্তী আর তার বাবা-মাকে বাড়িতে পৌঁছে দিলেন। তারপর থেকে প্রতিদিন স্কুল ছুটির পর একবার করে বাসন্তীকে দেখতে তাদের বাড়িতে যায় মানিক মাস্টার। বেশ কয়েকদিন যেতে না যেতেই বাসন্তী আগের চেয়ে অনেকটা সুস্থ হয়ে উঠলো। বাসন্তীর মা-বাবা মানিক মাস্টারকে বললেন। আপনার জন্যই আজ আমাদের মেয়ে সুস্থ হয়ে উঠেছে। সত্যি, আপনার এ ঋণ আমরা কোনোদিন শোধ করতে পারবো না মাস্টার। শুনে মাস্টার বললেন আমি না, আল্লাহ্ সুস্থ করেছেন আপনাদের মেয়েকে। আমি তো শুধু মাত্র মানুষ হিসেবে আমার কর্তব্য করেছি। এটা আমার মানবিক দায়িত্ব ছিল। আর ঋণ বলছেন কেন? ওই দেখুন বাসন্তী দূরে কেমন হাসছে খেলছে। ওর ঐ হাসির কাছে এটি কিছুই নয়। আমি চাই বাসন্তীর মুখের হাসির মতো বিশ্বের প্রতিটি শিশুর মুখে অমন স্বর্গীয় হাসি ফুটে ওঠে এ ভুবন ঝলমল করুক। সলিম মিয়া বললো,সত্যি মাস্টার আপনার মতো মহৎ মনের মানুষ আছে বলে বোধ হয় আজো প্রভু এ পৃথিবীটা টিকিয়ে রেখেছেন। আল্লাহ আপনার মঙ্গল করবেন। মানিক মাস্টার চলে গেলেন। তারপরদিন থেকে আবারো বাসন্তী আগের মতো হাসতে লাগলো। খেলতে লাগলো। পাড়ার ছেলে-মেয়েদের সাথে বই খাতা কলম নিয়ে স্কুলে যেতে লাগলো।

আজকালের খবর/আরইউ








সর্বশেষ সংবাদ
তাসকিন বললেন, ‘বেশিরভাগ সংবাদ এবং তথ্য গুজব’
ইসরায়েলের নতুন আদেশ নিয়ে জাতিসংঘের উদ্বেগ
নির্বাচন কমিশনের মামলায় খালাস পেলেন ইমরান খান
ফের শাহবাগ অবরোধ কোটা আন্দোলনকারীদের
পটুয়াখালীতে শিশু বলাৎকারের অভিযোগে মাদরাসা শিক্ষকের বিরুদ্ধে মামলা
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
দেবীদ্বারে ছেলেকে দেখতে এসে ট্রাক চাপায় মায়ের মৃত্যু
চোখ রাঙাচ্ছে বন্যা, সিলেটসহ পাঁচ জেলার নিম্নাঞ্চল প্লাবিত
শাহজালাল বিমানবন্দরে সাড়ে ৪ কোটি টাকার সোনা জব্দ
নাটোর জেলা বিএনপির আহ্বায়ককে কুপিয়ে জখম, সাবেক মেয়রসহ আহত ৭
৮ জুলাই চীন সফরে যাচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী
Follow Us
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি : গোলাম মোস্তফা || সম্পাদক : ফারুক আহমেদ তালুকদার
সম্পাদকীয়, বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : হাউস নং ৩৯ (৫ম তলা), রোড নং ১৭/এ, ব্লক: ই, বনানী, ঢাকা-১২১৩।
ফোন: +৮৮-০২-৪৮৮১১৮৩১-৪, বিজ্ঞাপন : ০১৭০৯৯৯৭৪৯৯, সার্কুলেশন : ০১৭০৯৯৯৭৪৯৮, ই-মেইল : বার্তা বিভাগ- newsajkalerkhobor@gmail.com বিজ্ঞাপন- addajkalerkhobor@gmail.com
কপিরাইট © আজকালের খবর সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত | Developed By: i2soft