শনিবার ২৭ জুলাই ২০২৪
বিশ্ব হোক শিশুশ্রম মুক্ত
অলোক আচার্য
প্রকাশ: মঙ্গলবার, ১১ জুন, ২০২৪, ৬:৩২ PM
অনুন্নত, উন্নয়নশীল দেশগুলোর একটি সাধারণ চিত্র হলো শিশুশ্রম। যা সেই দেশগুলোর উন্নয়নের জন্য একটি বড় বাধা হিসেবে কাজ করে। করোনা অতিমারী সেই অবস্থাকে আরেকটি প্রতিকূল পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিয়েছে। আগে থেকেই শিশুরা ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করতো এখন সে সংখ্যা আরো বেড়েছে। ২০২১ সালের জুনে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) এবং ইউনিসেফের একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্বব্যাপী শিশু শ্রমিকের সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ১৬০ মিলিয়ন। শেষ চার বছরে বাড়ে আট দশমিক চার মিলিয়ন। প্রতিবেদনে শিশুশ্রমে নিযুক্ত পাঁচ থেকে ১১ বছর বয়সী শিশুর সংখ্যা উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বৃদ্ধির বিষয়টি উঠে এসেছে, যে শিশুদের সংখ্যা বর্তমানে বিশ্বব্যাপী শিশুশ্রমে নিয়োজিত মোট শিশুর অর্ধেকের কিছু বেশি। শিশুদের স্বাস্থ্য, সুরক্ষা ও নৈতিকতার ক্ষতি করতে পারে এমন ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিযুক্ত পাঁচ থেকে ১৭ বছর বয়সী শিশুর সংখ্যা ২০১৬ সালের পর ৬৫ লাখ বেড়ে সাত কোটি ৯০ লাখে পৌঁছেছে।

শিশুশ্রম বলতে বোঝায় শিশুদের দ্বারা অর্থের বিনিময়ে শারীরিকভাবে ঝুঁকিপূর্ণ ও কমঝুঁকিপূর্ণ যেকোনো কাজ করানো। আমাদের দেশে এটি একটি সাধারণ ঘটনা। আমরা জানি আইনত এটা নিষিদ্ধ। তবু আমাদের কিছু করার নেই। একটি শিশু যখন শ্রমমূলক কাজে নিয়োজিত থাকে তখন তার ভেতর যে প্রতিভা থাকে তা বিকশিত হওয়ার সুযোগ পায় না। আমাদের কাক্সিক্ষত এসডিজি অর্জন করতে হলে শিশুশ্রম বন্ধ করা অত্যাবশ্যক। কিন্তু বর্তমান আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে শিশুশ্রম বন্ধ করা একটি সময়সাপেক্ষ এবং দীর্ঘ পরিকল্পনার বিষয়। বাংলাদেশ, ভারতসহ উন্নয়নশীল দেশগুলোতে শিশুদের জীবনযাত্রা উন্নত দেশের শিশুদের মতো না। একই পৃথিবীতে জন্ম নিয়ে আশ্চর্যজনকভাবে ভয়াবহ বৈষম্য নিয়ে বড় হয় এসব শিশুরা। গত বছরের জুলাই মাসে গণমাধ্যমে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানা যায়, গত ১০ বছরে দেশে শিশুশ্রমিকের সংখ্যা বেড়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্যানুযায়ী, বর্তমানে দেশে শিশুশ্রমিকের সংখ্যা ৩৫ লাখ ৩৭ হাজার, ২০১৩ সালে যা ছিল ৩৪ লাখ ৫০ হাজার জন। সম্প্রতি বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো-বিবিএস জাতীয় শিশুশ্রম জরিপ-২০২২ এ প্রকাশিত তথ্য থেকে এসব তথ্য জানা গেছে। 

বাস্তবতা হলো, এই বিপুল সংখ্যা শিশুকে শ্রমমূলক কাজ থেকে ফেরানো চ্যালেঞ্জিং বিষয়। তারপর আবার করোনার কারণে পরিস্থিতির বদল হয়েছে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) বাংলাদেশে শিশুশ্রম নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। তাতে দেখা গেছে, দেশে পাঁচ থেকে ১৭ বছর বয়সী প্রায় ৪৯ লাখ শিশু বিভিন্ন সেক্টরে শ্রমিক হিসেবে কাজ করে। বাংলাদেশের শিশু আইন-২০১৩ অনুসারে, অনুর্ধ্ব ১৮ (আঠারো) বছর বয়স পর্যন্ত সবাই শিশু হিসেবে গণ্য হবে। বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬-এ বলা হয়েছে, শিশুদের ন্যূনতম বয়স ১৪ বছর। এর কম বয়সীদের কাজে নিয়োগ করা যাবে না। প্রতি বছর ১২ জুন ‘বিশ্ব শিশুশ্রম প্রতিরোধ দিবস’ পালিত হয়। ২০০২ সালে সর্বপ্রথম দিবসটি পালন করা শুরু করে ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গানাইজেশন (আইএলও)। শিশু শ্রমের কারণে বাচ্চাদের দুর্দশার কথা তুলে ধরাই ছিল তাদের উদ্দেশ্য। আইএলও মনে করে, শিশু শ্রমের শিকার হওয়া শিশুদের দুর্দশার কথা তুলে ধরার বিষয়টি বিশ্বব্যাপী এই আন্দোলনকে এগিয়ে নিতে অনুঘটক হিসেবে কাজ করে। আইএলও কনভেনশন নম্বর ১৮২, যা শিশু শ্রমের সবচেয়ে খারাপ রূপের সঙ্গে এবং আইএলও কনভেনশন নম্বর ১৩৮, যেটি কর্মসংস্থানের জন্য ন্যূনতম বয়সের সঙ্গে সম্পর্কিত- এই দুই প্রধান ইস্যু নিয়ে কাজ করে। শিশুশ্রম বিশ্বজুড়েই একটি বড় মাথা ব্যথার কারণ। বিশেষত অনুন্নত এবং উন্নয়নশীল দেশগুলোতে এই চিত্র বেশি ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। এ ছাড়া বর্তমান বিশ্বে একটি বড় সমস্যা হলো যুদ্ধ বিপর্যস্থ অবস্থা। যুদ্ধ পরবর্তী সময়ে পরিবারের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি প্রতিকূল হলে শিশুর কাঁধেও সংসারের দায়িত্ব পরে। অর্থাৎ সে শ্রমমূলক কাজে জড়ায়।

রাষ্ট্রের একটা দায়িত্ব থাকে এসব শিশুরা যাতে ভারী এবং ঝুঁকিপূর্ণ কাজ না করে এবং সে বিষয়ে আইনও থাকে কিন্তু বাস্তব পরিস্থিতি ভিন্ন। অভাব না তো আইন দিয়ে আটকানো যায় আর না তো উপদেশ দিয়ে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পেটের জ্বালা মেটানোর জন্যই তারা কাজে নামে। শিশুরা গাড়ি ঠেলা, পাথর ভাঙা থেকে শুরু করে মাল টানা, ওয়েল্ডিং কারখানায় কাজ করে। ঝুকিপূর্ণ কাজের অনুমোদন না থাকলেও আসলে এই মুহূর্তে কিছুই করতে পারছি না। সচেতনতাও এক্ষেত্রে তেমন কিছু করতে পারে না যদি অভাব দূর না হয়। আগে পেট তারপর অন্যান্য সুযোগের প্রশ্ন আসে। পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, আমাদের দেশের শিশু শ্রমিকদের এক চতুর্থাংশ দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছে। বিশ্বজুড়ে শিশুশ্রমের পেছনে দারিদ্রতা, শিশু অধিকারের প্রতি সচেতনতা, পরিবারের অনাগ্রহ এসব বিষয় জড়িত আছে। লেখাপড়া এবং আনন্দপূর্ণ শৈশব ছেড়ে কেন একজন শিশু হাতে হাতুড়ি তুলে নেয় সে প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হবে আমাদের। কারণ আমাদের উন্নয়নের যে লক্ষ্য তা সম্পূর্ণ হবে না যতক্ষণ এ অবস্থা থেকে আমরা বের হয়ে আসতে পারি। সবার জন্য শিক্ষা নিশ্চিত করতে সরকারের যে লক্ষ্য তা অর্জন করতে হলে প্রতিটি শিশুর হাতেই বই, খাতা, কলম তুলে দিতে হবে। দেখা যায় বেশিরভাগ শিশুই তাদের এই রোজগারের বড় অংশই পরিবারের প্রয়োজনে ব্যয় করে। যে বয়সে একটা শিশুর বই খাতা নিয়ে স্কুলে যাওয়ার কথা, লেখাপড়ায় মনোযোগী থাকার কথা সেখানে সে অতি অল্প বেতনে এমনকি প্রায় বিনা বেতনে (কেবলমাত্র কাজ শেখার শর্তে) ঝুঁকিপূর্ণ কাজ করে চলেছে। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) শ্রম নিয়োগ সম্পর্কে যে মান নির্দিষ্ট করে দিয়েছে, সেখানে মূলত চারটি মাত্রার কথা বলে হয়েছেÑ সংগঠিত হওয়ার স্বাধীনতা, যৌথ দর-কষাকষির অধিকার, শিশুশ্রমিকের অনস্তিত্ব ও বৈষম্যহীন নিয়োগ ব্যবস্থা।

কোনো বাবা-মা বা সেই দেশ তার দেশের শিশুদের দিয়ে কাজ করাতে চায় না। কারণ শিশুরা হলো সম্পদ। দেশকে এগিয়ে নিতে এইসব শিশুরাই সক্ষম। কোন দেশ কতটা উন্নত সেটা বুঝতে হলে সেদেশের শিশুদের অবস্থা পর্যবেক্ষণ করাই যথেষ্ট। কারণ কোনো শিশুই উপার্জন করার মতো কাজ করতে চায় না কিন্তু পরিস্থিতি সেটা করতে বাধ্য করে। শিশুদের স্বার্থ রক্ষায় সব দেশের সরকারই বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়। কারণ প্রতিটি সিনিয়র জনগণ তাদের দেশের শিশু পরিস্থিতি ভালো দেখতে চায়। শিশুদের শ্রম বা ঝুঁকিপূর্ণ কাজ থেকে বিরত রাখতে অগ্রগণ্য একটি পদক্ষেপ হলো সবার জন্য শিক্ষা নিশ্চিত করা। তারা বই খাতা নিয়ে স্কুলে যাবে। শ্রমজীবিদের একটি অংশই শিশু এটা ভাবতেই কষ্ট হয়। আপনি যে রিকশায় উঠবেন লক্ষ্য করলে দেখা যাবে সেটা কোনো শিশু চালাচ্ছে। যে গাড়িতে উঠবেন সেটার চালকও কোনো শিশু। এমনকি যানবাহন চালাতেও দেখা যায় শিশুকে। আমরা তা দেখতে চাই না। আমরা শিশুর জন্য নিরাপদ বাসযোগ্য পরিবেশ গড়তে চাচ্ছি তা থেকে অনেক দূরে আমাদের অবস্থান। আমরা একটি শিশুশ্রম মুক্ত বাংলাদেশ এবং বিশ্ব গড়তে চাই। সে লক্ষ্যে অগ্রসর হতে প্রয়োজন শিশুবান্ধব পরিবেশ। 

তবে দক্ষিণ এশিয়ার উন্নয়নের গলার কাঁটা হলো শিশু শ্রম। তার মধ্যে আমাদের দেশও রয়েছে। ঐকান্তিক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও তা দূর করা যাচ্ছে না। এর বড় একটি কারণ হলো পারিবারিক দায়। পরিবার থেকেও বিষয়টিকে নিরুৎসাহিত বা শিশুকে কাজ থেকে ফেরানোর চেষ্টা করা হচ্ছে না। ফলে শিশু শ্রম বাড়ছে। তা ছাড়া জীবিকার প্রয়োজনে পরিবারও অসহায়। সব দিক বিবেচনায় শিশুদের শতভাগ স্কুলে ফেরানোর কোনো বিকল্প নেই। তাদের শিক্ষায় শিক্ষিত করার মাধ্যমেই এই সমস্যার সমাধান সম্ভব। একটি উন্নত স্মার্ট বাংলাদেশে ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রমের বা শিশু শ্রমের কোনো জায়গা থাকবে না এটাই প্রত্যাশা।  এজন্য সমাজের সর্বস্তরের মানুষের সহযোগিতা এবং সরকারের যুগোপযোগী পদক্ষেপ প্রয়োজন। নচেৎ উন্নয়ন দৃশ্যমান হলেও তার একটি দিক থাকবে দুর্বল। আমরা চাই না কোনো শিশু ভারী হাতুড়ি দিয়ে কাজ করুক, আমরা চাই না কোনো শিশু ইট হাতে ইমারত গড়ে তুলুক। আমরা চাই প্রতিটি শিশু সকাল হলেও বই খাতা গুছিয়ে স্কুলে যাক আবার স্কুল শেষে হাসিমুখে বাড়ি ফিরুক। একটি সভ্য পৃথিবীর এটাই চিত্র হওয়া উচিত।  

লেখক : প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট।

আজকালের খবর/আরইউ








সর্বশেষ সংবাদ
ভিন্ন ধাঁচে প্যারিস অলিম্পিকের উদ্বোধন
‘জন্মদিনে নিজের মৃত্যুসংক্রান্ত পোস্ট লেখার কোনো ইচ্ছা ছিল না’
ঢাকা-বরিশাল রুটে সীমিত পরিসরে লঞ্চ চলাচল শুরু
ডোনাল্ড ট্রাম্পকে জিজ্ঞাসাবাদ করবে এফবিআই
আজ ঢাকাসহ ৪ জেলায় বিকেল ৫টা পর্যন্ত কারফিউ শিথিল
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
বাংলাদেশ নিয়ে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে রুপা-আপসানার প্রস্তাব
রিমান্ড শেষে কারাগারে নুর
ফেসবুক-টিকটকের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার হুঁশিয়ারি
ফরিদপুরে ১৪ ঘণ্টার জন্য কারফিউ শিথিল, চলছে যানবাহন
জাবি শিক্ষকের ‘পদত্যাগ নাটক’
Follow Us
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি : গোলাম মোস্তফা || সম্পাদক : ফারুক আহমেদ তালুকদার
সম্পাদকীয়, বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : হাউস নং ৩৯ (৫ম তলা), রোড নং ১৭/এ, ব্লক: ই, বনানী, ঢাকা-১২১৩।
ফোন: +৮৮-০২-৪৮৮১১৮৩১-৪, বিজ্ঞাপন : ০১৭০৯৯৯৭৪৯৯, সার্কুলেশন : ০১৭০৯৯৯৭৪৯৮, ই-মেইল : বার্তা বিভাগ- newsajkalerkhobor@gmail.com বিজ্ঞাপন- addajkalerkhobor@gmail.com
কপিরাইট © আজকালের খবর সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত | Developed By: i2soft