সম্প্রতি চীনের গুয়ানলানে দেশের খ্যাতিমান ছাপচিত্রশিল্পী এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চারুকলা অনুষদের অধ্যাপক আনিসুজ্জামান আনিস তিন সপ্তাহের একটি সম্মানজনক রেসিডেন্সি কর্মশালা শেষ করে এসেছেন। ২০১১ সালে আন্তর্জাতিক গুয়ানলান ছাপচিত্র বিয়েন্নালে পুরস্কৃত এই শিল্পী এর আগে এশিয়ান বিয়েন্নালেও গ্র্যান্ড প্রাইজ লাভ করেছিলেন। তিনি আমেরিকার বিখ্যাত পোলক-কার্সনার ফাউন্ডেশন এবং কানাডার গ্রিনশিল্ড ফাউন্ডেশনের বৃত্তিপ্রাপ্ত সমকালের একজন গুরুত্বপূর্ণ ছাপচিত্রশিল্পী।
শিল্পী আনিসুজ্জামান আনিস তার সাম্প্রতিক সিরিজ ‘বহুবর্ণিল জটিলতা’ সিরিজের জন্যে সারাবিশ্বে প্রশংসিত। নাগরিক সমৃদ্ধি এবং বহুতল উন্নয়ন জটিলতা নিয়ে এক যুগেরও বেশি সময় ধরে তিনি কাজ করছেন। উডব্লক প্রিন্ট মাধ্যমকে তিনি অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। শিল্পগুরু সফিউদ্দিন আহমেদ, রফিকুন নবী এবং আবদুস সাত্তারের পর এই মাধ্যমে তিনি একজন আলোচিত শিল্পী। এশিয়ান বিয়েন্নালে বাংলাদেশের যে দুই শিল্পী উডব্লক প্রিন্ট মাধ্যমে গ্র্যান্ড প্রাইজ পেয়েছেন তিনি তাদের একজন। অন্যজন আবদুস সাত্তার।
বহুবর্ণিল জটিলতা সিরিজ এবং গুয়ানলান রেসিডেন্সি নিয়ে শিল্পী আনিসুজ্জামানের সঙ্গে দীর্ঘ কথোপকথনের ভিত্তিতে লেখাটি প্রস্তুতকৃত।
শিল্পী আনিসুজ্জামান বলেন, ‘বহুবর্ণিল জটিলতা সিরিজটি আমি ২০০৯ সালে শুরু করেছি এবং এখনো চলছে। আমাদের রাজধানী ঢাকার দ্রুত নগরায়ন দেখতে দেখতে আমার মাথায় এটি এসেছিল। এই সিরিজের মাধ্যমে আমি একদিকে নগরায়নের প্রয়োজনীয়তা এবং এর নেতিবাচক দিক ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছি। আমরা জানি বাংলাদেশ খুব দ্রুত উন্নয়নশীল দেশ, কিন্তু কোনো না কোনোভাবে আমরা বেশকিছু অদৃশ্য জটিলতার সম্মুখীন হচ্ছি যাকে আমি বহুবর্ণিল জটিলতা হিসেবে বর্ণনা করতে ভালোবাসি।’
গুয়ানলান রেসিডেন্সি নিয়ে তিনি বলেন, ‘ব্যক্তিগত সমৃদ্ধি, বিকাশ এবং স্থিতিশীলতা শেয়ার করা সমসাময়িক বিশ্বে অনেক গুরুত্বপূর্ণ। এটি আন্তঃব্যক্তিক সংযোগ, যোগাযোগের দক্ষতা এবং আন্তঃজাতিগত চিন্তা বিকাশে সহায়তা করে। আমি গুয়ানলানে কাজের মধ্যে ছিলাম এবং সত্যিই একটি প্রাণবন্ত সময় কেটেছে। আমার কাছে এই প্রিন্ট ওয়ার্কশপে কাজের প্রকৃতি অনেকটাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব বিভাগের মতো। আমি সেখানের প্রিন্টমেকিং বেইজের নিজস্ব আধুনিক ভবনের ডিজাইন নিয়ে দুটো কাজ করেছি যা উপস্থিত সকলের ভালো লেগেছে।’
ঢাকা চারুকলার প্রিন্টমেকিং বিভাগ প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৪৮ সালে। প্রথমে এটি গ্রাফিক আর্ট বিভাগ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এই নামটি ১৯৭৮ সালে পরিবর্তন করে ছাপচিত্র বিভাগ করা হয়। ২০০৮ সালে যখন চারুকলা ইন্সটিটিউট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি অনুষদ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে, তখন এটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের অধীনে একটি সুপরিচিত বিভাগ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়। এটি বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম সেরা বিভাগ। অনেক নামকরা শিক্ষক ও পণ্ডিত এই বিভাগে কাজ করেছেন। আনিসুজ্জামান আনিস এই বিভাগের একজন সাবেক ছাত্র এবং শিক্ষক। উল্লেখ্য অতীতে এই বিভাগে সফিউদ্দিন আহমেদ, মোহাম্মদ কবরিয়া, মাহমুদুল হকের মতো গুণিজন শিক্ষকতা করেছেন।
ছাপচিত্র বিভাগের কাজ সম্পর্কে আনিস বলেন, ‘আমাদের বিভাগে প্রিন্ট মেকিংয়ের সমস্ত কৌশল এবং পদ্ধতি রয়েছে। রিলিফ প্রক্রিয়া, ইন্টাগ্লিও প্রক্রিয়া (এচিং, একুয়াটিন্ট, ড্রাইপয়েন্ট, ইত্যাদি), প্ল্যানোগ্রাফিক প্রক্রিয়া (লিথোগ্রাফ), কলোগ্রাফ এবং মনোপ্রিন্ট। আমি আমার ছাত্রদের বিশেষভাবে যা শেখাই তা হল কাঠখোদাই প্রিন্ট প্রক্রিয়া।’
গুয়ানলান রেসিডেন্সির অভিজ্ঞতা সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘চীনের প্রিন্ট মেকিংয়ের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। এ ছাড়া জাপানের একটি সমৃদ্ধ ইতিহাসও রয়েছে। আমি জাপানে পড়াশোনা করার সঙ্গে সঙ্গে আমাকে চীনের ঐতিহাসিক ছাপচিত্র আন্দোলন সম্পর্কে পড়তে হয়েছে। চিনের বিখ্যাত ছাপচিত্রশিল্পীদের কাজ নিবিড়ভাবে দেখতে হয়েছে। বর্তমান সময়ে ঝ্যাং ঝিয়াওশুন, ঝ্যাং মিনজি, হাও পিং প্রমুখের কাজ আমার ভালো লাগে।’ গুয়ানলান প্রিন্টমেকিং বেইজের উপপরিচালক চাও জিয়ানচুনের কাছে নিজের কৃতজ্ঞতার কথা তিনি জানান। ছাপচিত্র নিয়ে ভবিষ্যতে চীন এবং বাংলাদেশ যৌথভাবে কাজ করবে বলেও তিনি আশাবাদ প্রকাশ করেন।
ছাপচিত্র একটি কঠিন মাধ্যম। গভীর ধ্যান ও অনুশীলনের মাধ্যমে মাধ্যমটিকে রপ্ত করতে হয়। কীভাবে তরুণ শিল্পীরা এই মাধ্যমে ভালো করতে পারবে? তিনি বলেন, ‘আমাদের অনেক অনুরাগ দরকার। গ্লোবাল প্রিন্ট মেকিং মুভমেন্টগুলোর দিকে চোখ রাখা উচিত। এটি একটি ধারাবাহিক প্রক্রিয়া। তরুণ এবং প্রতিশ্রুতিশীল প্রিন্টমেকারদের আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীতে অংশগ্রহণ করা উচিত, তাদের অবশ্যই যাদুঘর এবং গ্যালারি পরিদর্শন করতে হবে এবং ক্যাটালগ এবং জার্নাল সংগ্রহ করতে হবে। তাহলেই এই মাধ্যমে সফল হওয়া সম্ভব।’
আজকালের খবর/আরইউ