শনিবার ২৭ জুলাই ২০২৪
একই ব্যথা
আবুল কালাম আজাদ
প্রকাশ: শনিবার, ২০ মে, ২০২৩, ৩:২১ PM
অফিস থেকে বের হলাম ৫টায়। জ্যৈষ্ঠ মাস। দিন বড়ো। সূর্য তখনো তেজোদীপ্ত। বাতাস গরম। কাছেই একটা রিকশা। চালক মোটামুটি বৃদ্ধ। তবে এ ধরনের মানুষের বয়স ঠিক ধরা যায় না। অর্থকষ্ট, নানাবিধ দুশ্চিন্তায় এদের অনেকেই অল্প বয়সে বৃদ্ধ হয়ে যায়। কেউ কেউ আবার অর্থকষ্টকে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে মজা মেরে জীবন কাটায়। 
রিকশাওয়ালাকে বাসার ঠিকানা বললাম। সে ভাড়া চাইল চল্লিশ টাকা। দশ টাকা বেশি চেয়েছে। তীব্র গরম। বৃদ্ধ মানুষ। গরিব তো অবশ্যই। এসব বিবেচনা করে দর কষাকষি করলাম না। রিকশায় উঠে বসলাম। 
রিকশা যে গতিতে চলার কথা সে গতিতে চলছে না। গতি খুবই ধীর। পেছন থেকে রিশকওয়ালাকে যতটা লক্ষ করা যায় করতে লাগলাম। 
মনে হল, সে পূর্ণশক্তি দিয়ে প্যাডেল চাপতে পারছে না। মনে হচ্ছিল, তার পায়ে অথবা কোমড়ে ব্যথা। সে কাঁধের গামছা দিয়ে বার বার মুখ মুছছিল। সে কি ঘাম মুছছে? নাকি চোখের পানি মুছছে? 
একটু এগিয়ে রাস্তার পাশে একটা পাকুড়গাছ। রাস্তার ওপারে একটা বটগাছও আছে। বটগাছ যেখানে তার কাছাকাছি একটা পাকুড়গাছ থাকেই। অথবা পাকুড়গাছের কাছাকাছি একটা বটগাছ থাকেই। আমি আজ পর্যন্ত এর ব্যতিক্রম দেখিনি। এর পেছনের রহস্য উদ্ভিদবিজ্ঞানীরাই ভালো বলতে পারবেন। তবে বট-পাকুড় বলতে আমাদের কল্পনায় যে বিশাল বৃক্ষ চলে আসে এ গাছ দু’টি সেরকম না। মাঝারি আকারের। ঢাকা শহরের বিরূপ পরিবেশ মোকাবিলা করে ওরা যে টিকে আছে এটাই ওদের জন্য অনেক কিছু। 
পাকুড়গাছের নিচে একটা চায়ের দোকান। সেখানে গিয়ে বললাম-চাচা মিয়া, রিকশাটা একটু রাখেন। 
অমনি সে রিকশা থামিয়ে দিল। আমি রিকশা থেকে নামলাম। চাচা মিয়ার দিকে তাকিয়ে দেখি তার চোখ দুটো টকটকে লাল। মুখে কষ্টের ছাপ। কষ্টটা কি মানসিক, নাকি শারীরিক? আমি বললাম-আসেন চা খাই। 
সে কোনো কথা না বলে নিঃশব্দে আমার পেছনে হেঁটে চায়ের দোকানে এলো। দোকানে একজন মাত্র লোক বসেছিল। তার হাতে আধাশূন্য একটা চায়ের কাপ। আমরা ঢুকতেই সে কাপে লম্বা একটা চুমুক দিয়ে কাপটা নামিয়ে উঠে দাঁড়াল। বলল-বসেন। সে চায়ের দাম মিটিয়ে চলে গেল। আমি বসলাম। রিকশাওয়ালা চাচা মিয়া দাঁড়িয়ে। তাকে আমার পাশে বসতে বললাম। সে খুব গুটিশুটি হয়ে বসল। 
আমি চায়ের দোকানদারকে বললাম-চিনি ছাড়া দুই কাপ দুধ চা দেন। পরক্ষণেই রিকশাওয়ালা চাচা মিয়াকে জিজ্ঞেস করলাম-আপনারটায় কি চিনি হবে? সে মাথা নেড়ে না সূচক উত্তর দিল। 
চায়ের কাপ হাতে নিয়ে বললাম-আপনার কি শরীর খারাপ? 
সে বলল-পায়ে আর কোমড়ে ব্যথা। আঘাত পেয়েছেন? কয়দিন আগে এক গাড়ির ধাক্কায় রিকশা নিয়া উল্টায়া পড়ছিলাম। 
আহা! তা ছাড়া মনটাও খারাপ। মন খারাপ কেন?
সে আর কিছু বলে না। চায়ের কাপ হাতে নিয়ে মাথা নিচু করে বসে রইল। আমি তার মুখে তাকিয়ে। তার মাথাটা আস্তে আস্তে নিচের দিকে ঝুঁকে যাচ্ছে। এক সময় আমি আর তার মুখ দেখতে পারি না। আমি বললাম-মন খারাপ কেন আপনার?
হঠাৎ সে হাতের কাপ ফেলে দিয়ে পেছনের দেয়ালে মুখ ঠেসে ধরে উচ্চকণ্ঠে কেঁদে উঠল। আমি অসহায়ের মতো তার কান্না দেখতে লাগলাম। আমি অনেকটা হতভম্ব। চায়ের দোকানদার বলল-সমস্যাটা কী?
সে বেশ কিছুক্ষণ কাঁদল। বোঝা গেল এ কান্নায় তার বুকের কষ্টের বরফ গলেনি। বুকের ভেতর আরো অনেক কান্না আটকে আছে। আমার দেরি হয়ে যাচ্ছে ভেবেই হয়ত সে কান্নার স্রোতে বাধ দিল। বলল-চলেন যাই। 
আমি বললাম-কাঁদছেন কেন? কী হয়েছে? দুইদিন আগে আমার মেয়ে মারা গেছে। মেয়ে...! কতবড়? কীভাবে...? কিলাশ থিরিতে পড়ত। পানিতে ডুইবা। 
ক্লাশ থ্রি! আমার শরীর একটা ঝাকুনি খেল। বললাম-মেয়ে কি গ্রামে মারা গেছে? জে।
তো আপনি ঢাকায় কেন? বাড়িতে যাননি? ঈদের জন্য ভাড়া বেশি। ১৪শ ট্যাকা ভাড়া। ভাড়ার ট্যাকা জোগাড় করতে পারি নাই। সকালেও মেয়েটা আমার সাথে ফোনে কথা কইছে। কইছে-বাজান, কবে আসবা? আমার জন্যি খাতা আর পেন্সিল নিয়া আইসো। বিকালে খবর পাইলাম...! সে আবার ডুকরে কাঁদতে লাগল। 
চৌদ্দশ টাকা। খুবই সামান্য টাকা। যে দেশে উন্নয়নের বান ডেকে যাচ্ছে সে দেশে একটা বাবা চৌদ্দশ টাকার জন্য তার কলিজার টুকরাটাকে শেষ দেখা দেখতে যেতে পারে না। অর্থের কাছে মানুষ কত অসহায়! 
অফিসে যাওয়ার সময় সাধারণত মানিব্যাগে পকেট খরচটাই রাখি। তার পাঁচ-ছয়শর বেশি হয় না কখনোই। মনে মনে হিসাব কষে দেখলাম শখানেক ভাঙতি টাকা আর পাঁচশ টাকার একটা নোট আছে। সেটি বের করে বললাম-এটি রাখুন। তখনই চায়ের দোকানদার তার ড্রয়ার খুলে দুটো পাঁচশ টাকার নোট বের করে বলল-এইটা নাও। তুমি আইজই বাড়ি যাও। 
আমি চায়ের দোকানদারকে বললাম-আমি কাল আপনাকে টাকাটা দিয়ে দেব। 
সে বলল-এই কথা বইলেন না স্যার। আমার মেয়েটাও কিলাশ থ্রিতে পড়ে। আমার দম বন্ধ লাগতাছে। সে গামছা দিয়ে চোখ মুছতে লাগল। 
তখনই আমার ফোন বেজে উঠল। স্ত্রীর নাম্বার থেকে ফোন এসেছে। ফোন রিসিভ করতেই আমার ক্লাস থ্রিতে পড়ুয়া মেয়ে বলল-বাবা, কখন আসবে? অফিস কি ছুটি হয় নাই? আসছি মা। লোকটা তখন ১৬শ টাকা বুকে চেপে ধরে হাহাকার করে কাঁদছে-ভাড়ার ট্যাকা পাইলাম, দুইদিন আগে পাইলাম না। তায়লে তো আমার মায়ের মুখটা দেখবার পারতাম। মারে, তুই আর আমার কাছে খাতা-পেনসিল চাইবি না! একটা ব্যথা তিনজন মানুষের বুকে সমানভাবে বিঁধতে লাগল। তিনজন বাবা। 
 
আজকালের খবর/আরইউ








সর্বশেষ সংবাদ
মার্কিন শ্রমনীতি পোশাক রপ্তানিতে নেতিবাচক অবস্থা তৈরি করতে পারে: পররাষ্ট্র সচিব
স্বতন্ত্র প্রার্থী শাহজাহান ভূঁইয়ার কর্মীদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা-হয়রানি
একদিনে দশটি পথসভা, উঠান বৈঠক ও একটি জনসভা করেন সাজ্জাদুল হাসান এমপি
নতুন বছরে সুদহার বাড়ছে
শেখ হাসিনার প্রতি আস্থা রেখেই আজকের উন্নত বাংলাদেশ
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
রাজপথের আন্দোলনে জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা হবে: মুরাদ
অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে অনন্য ভূমিকায় ইসলামী ব্যাংক
ইতিহাসের মহানায়ক: একটি অনন্য প্রকাশনা
নতুন বই বিতরণ কার্যক্রম উদ্বোধন করলেন প্রধানমন্ত্রী
এক দিনে সারাদেশে ২১ নেতাকে বহিষ্কার করল বিএনপি
Follow Us
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি : গোলাম মোস্তফা || সম্পাদক : ফারুক আহমেদ তালুকদার
সম্পাদকীয়, বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : হাউস নং ৩৯ (৫ম তলা), রোড নং ১৭/এ, ব্লক: ই, বনানী, ঢাকা-১২১৩।
ফোন: +৮৮-০২-৪৮৮১১৮৩১-৪, বিজ্ঞাপন : ০১৭০৯৯৯৭৪৯৯, সার্কুলেশন : ০১৭০৯৯৯৭৪৯৮, ই-মেইল : বার্তা বিভাগ- newsajkalerkhobor@gmail.com বিজ্ঞাপন- addajkalerkhobor@gmail.com
কপিরাইট © আজকালের খবর সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত | Developed By: i2soft