ভারী বর্ষণ। যেন মেঘ ফেটে গেছে। উপর থেকে প্রবল বাতাস, বৃষ্টির ঘন ফোঁটা ঢেউয়ে, পাহাড়ের এদিক-ওদিক, কখনো তার উপরে আছড়ে পড়ছে। লম্বা পাইন গাছগুলো ছন্দে দুলছে, যেন প্রকৃতির সঙ্গীতে নাচছে। পাহাড়ের প্রতিটি কোণ থেকে ছোট ছোট ঝরনাগুলো তাদের পথ তৈরি করে প্রবাহিত হতে থাকে। যেন ঝরনারা বলছে ‘আজ আমরা সবাই বন্ধন থেকে মুক্ত’। এমন প্রবল বৃষ্টির মধ্যে উজমা সাধ্যমতো চেষ্টা করছে ছোট্ট বাসস্টপে পৌঁছানোর। পাহাড়ের গা ঘেঁষে বানানো হয়েছে একটু ওঠার পর। ঘন গাছের মাঝে বাসা বেঁধে থাকা ছোট্ট সুন্দর পাহাড়ি শহর, দেখতে খুব সুন্দর হলেও প্রকৃতির রুক্ষ রূপ এখানেও ভীতিকর লাগে। দৌড়াতে গিয়ে উজমার জুতা ছিঁড়ে যায়। কামিজটা গায়ের সাথে আটকে গেল, তবুও কোনোরকমে বাসস্টপে পৌঁছে গেল। রাস্তাঘাট জনশূন্য। ঠাণ্ডায় কাঁপতে কাঁপতে মুখের উপর আসা চুলগুলো ঢেকে বসে থাকল।
এই বৃষ্টি ঝলসে যাওয়া পৃথিবীতে পড়লেই তার তাপ ঝেড়ে ফেলে। ঠিক এভাবে হৃদয়ে বসতি কিছু বিশেষ স্মৃতিও জাগিয়ে তোলে। এমনই এক বৃষ্টিভেজা সন্ধ্যায় নুহাশ কানিজকে কোলে জড়িয়ে ধরেছিল, তার ভেজা কপালে ঠোঁট ছুঁয়ে তাকে ভালোবাসার অমূল্য উপহার দিয়েছিল। ইতস্তত করে কানিজও নুহাশের উষ্ণ নিঃশ্বাস অনুভব করে নিজেকে তার হাতে তুলে দিয়ে স্পর্শে হারিয়ে গিয়েছিল।
দুজনেই একই স্কুলে পড়াতো। নুহাশ স্কুলে একজন শিক্ষক। উজমা বিএড পড়ছে। বিএড-এ প্রাকটিক্যাল দিতে নুহাশের স্কুলে যেতে হয়েছে। তারপর থেকে দুজনে বন্ধু। বিএডের পর নুহাশ তাকে তার স্কুলে চাকরি দেয়। তবে দুজনের চাকরি নিশ্চিত হয়নি। বন্ধুত্ব ধীরে ধীরে প্রেমে পরিণত হয়। উজমা সবসময় দুটো টিফিন নিয়ে আসে, একটা নিজের জন্য আর একটা নুহাশের জন্য। প্রায়ই দুজনেই স্কুল শেষে হারিয়ে যায় কিছু হাসির মুহূর্ত কাটাতে। অস্তগামী সূর্য দেখো নুহাশ, সে প্রতিদিন আমাদের দেখে। আমাদের ভালোবাসার সাক্ষী।
এরই মধ্যে নতুন একজন শিক্ষিকাকে নিয়ে স্কুলের কর্মচারীদের মধ্যে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয়। নতুন শিক্ষিকা তিথিকে স্বাগত জানাল সবাই। তিথির বাবা অনেক বড় উকিল। পুরো শহর তাকে চেনে। তিথির ব্যক্তিত্বেও একই অবস্থা দৃশ্যমান। বকবক শুনে মনে হবে বক্তৃতায় জন্ম থেকেই পটু। চোখ বন্ধ করে কথা বলার একটা স্টাইল তার মধ্যে। স্বর্ণকেশী চুল, গোলাপী লাল গাল, গোলাপী ঠোঁট সবাইকে তার দিকে আকৃষ্ট করল। বিশেষ করে সব পুরুষ কর্মী। চারপাশে যারা দাঁড়িয়ে ছিল, তিথি করমর্দনের জন্য নুহাশের দিকে হাত বাড়ালে নুহাশ আতঙ্কিত হয়ে হ্যালো বলে পিছিয়ে গেল।
তিথি নুহাশের পাশের চেয়ারটা নিল। এই ভেবে যে, উভয়ের বিষয় একই, কিছু জিজ্ঞেস করে কাজ ঠিকভাবে হবে।
নুহাশ দরিদ্র ঘরের, খুব উচ্চাভিলাষীও। সে উপরে উঠার সিঁড়ি খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে। কিন্তু প্রতিবারই ব্যর্থ হয়েছে। ধীরে ধীরে তিথি আর নুহাশের কথা বাড়তে থাকে। প্রায়ই তিথি তার বাবার উচ্চ লোকের সাথে সুসম্পর্ক আলোচনা করে। নুহাশকে আশ্বস্ত করে বলে, তার বাবা তাকে যেকোনো জায়গায় ভালো চাকরি দেবে।
এরপর থেকে যখনই নুহাশ আর উজমা সঙ্গে থাকে, শুধু তিথির প্রশংসা করে। কিন্তু উজমা ভালোবাসার প্রতি পূর্ণ বিশ্বাস রেখেছে। তিথি প্রায়ই নুহাশের সামনে উজমার পোশাক নিয়ে মজা করে। তখন নুহাশের নীরবতা দেখে উজমার খুব খারাপ লাগে।
নুহাশ, আজ টিফিন খাওনি?
হ্যাঁ, আজ তিথি টিফিন এনেছিল। তাই ওর সাথে খেয়েছি।
ছোটখাটো ব্যাপার হলেও উজমার ভেতরে ভেতরে দংশন করছে। তার উদাসীনতা বাড়তে থাকে। সে সবকিছু নুহাশের ওপর অর্পণ করেছে, তার খারাপ লাগবে না কেমন করে?
উজমাও তিথির মতো নিজেকে সাজাতে শুরু করল। কিন্তু নুহাশ আগের মতো পাত্তা দিল না। উজমা অভিযোগ করলে সে শুধু বলে, না, এরকম কিছু নেই যেরকম তুমি ভাবছো।
একদিন উজমার স্বাস্থ্যের অবনতি হয়। স্কুল থেকে অর্ধেক বেলা ছুটি নিয়ে সে চলে গেল ডাক্তারের কাছে। ডাক্তার যা বললেন তা শুনে উজমার পায়ের নিচের মাটি সরে গেল- তুমি গর্ভবতী।
উজমা তাড়াতাড়ি নুহাশকে ফোন করল, পুরো ব্যাপারটা খুলে বলল।
যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ব্যবস্থা করিয়ে নাও। আমি এখনও নিজেকে স্থির করিনি, তোমাদের দুজনের দায়িত্ব নিতে পারছি না। জীবনে আমার অনেক কিছু করার আছে।
চলো বিয়ে করি।
পাগল নাকি? মা আর দুই বোনের ভার আমি সইতে পারছি না, আবার দুজনের?
নুহাশের রাগের কারণে উজমা ভয় পেয়ে যায়। কয়েকদিন ধরে নুহাশ অনুনয়-বিনয় করতে থাকে। এই পরিস্থিতির জন্য সেও সমান দায়ী। কিন্তু এখনই যদি হাসপাতালে গিয়ে ব্যবস্থা না নেওয়া হয়! কিন্তু উজমা একা হাসপাতালে যাবে না। নুহাশের চাপ বেড়ে যাওয়ায় একদিন মুখ লুকিয়ে হাসপাতালে যায়, এই প্রেমময় পাপের চিহ্নের অবসান ঘটাতে। খুব ভয়ে নার্স আর ডাক্তারকে খোলাখুলি বলল। নুহাশ ভেতরে এলো না। সে চোখ বন্ধ করে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকল। কিছুক্ষণ পর উজমা বাড়ি ফিরল।
নুহাশ নিশ্চিত সে যা চেয়েছে উজমা তাই করেছে। নুহাশের আচরণে উজমা বিরক্ত। একদিন জানা গেল, নুহাশ একটা বড় শহরে খুব ভালো চাকরি পেয়েছে। শীঘ্রই দেখা করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে সে চলে যায়। কিছুদিন পর তিথিও স্কুল ছেড়ে দেয়। কর্মীদের মধ্যে আলোচনা হলো নুহাশ আর তিথির বিয়ে হয়েছে। কিন্তু উজমা বিশ্বাস করেনি।
নুহাশ আর ফিরে আসেনি। উজমা পেছনে ফেলে যায়, তার হৃদয়ে প্রথম প্রেমের তিক্ত স্মৃতি। সেই শহরে বাস করে নুহাশের ভালোবাসা আর ছলনা ভুলা কঠিন ছিল। স্কুলের স্টাফরুম, পাহাড়ি নদীর তীর, প্রেমিক-প্রেমিকাদের জন্য বানানো বনানী, এক জায়গায় তার অসম্পূর্ণ গল্পের অনুভূতি যন্ত্রণা হয়ে তীব্র নাড়া দিতে লাগল। উজমাও সেই জায়গা ছেড়ে অন্য শহরে চলে এলো। এখানে শিক্ষকতা শুরু করল।
বৃষ্টি থেমে গেছে। বাসস্টপে বসে থাকা উজমার চোখে জল। পনেরো বছর পেরিয়ে গেছে, আজও যখনই বৃষ্টি হয়, নুহাশের ছলনাগুলো প্রেমের ভুলের মতো ঝরতে থাকে। ওড়না দিয়ে মুখ পরিষ্কার করে, ছেঁড়া জুতা ধরে, সে চলতে শুরু করতেই তার সামনে একটা গাড়ি এসে থামল। একটি পরিচিত মুখ গাড়ি থেকে নেমে তার দিকে আসতে লাগল।
অনেকদিন তোমায় খুঁজছি, আজ খুঁজে পেলাম। কেমন আছো উজমা?
এত বছর পর হঠাৎ নুহাশকে সামনে দেখে উজমার মুখে রাগ, বিরক্তি আর বিস্ময়ের মিশ্র ভাব ফুটে উঠল। এই মুহূর্তে তার ভেতরে জেগে উঠা অনুভূতিগুলোকে শব্দের রূপ দিতে পারল না।
আমি তোমার কাছে অপরাধী। আমি তোমাকে অনেকবার সত্য বলার কথা ভেবেছি কিন্তু সাহস জোগাড় করতে পারিনি। তিথির বাবা আমাকে খুব ভালো চাকরি দিয়েছিলেন কিন্তু শর্ত ছিল আমাকে তিথিকে বিয়ে করতে হবে। পাওয়ার লোভে সব ভুলে গেছি। একটি উচ্চ পদ এবং স্বার্থপর হয়ে উঠেছিলাম। বিয়ের পনেরো বছর পরও আমি নিঃসন্তান। তিথি কখনও মা হতে পারবে না, এই বিষয়টি আমার কাছে লুকিয়ে ছিল। হয়তো আমার পাপের ফল আল্লাহ আমাকে দিয়েছেন। সেই সময় তুমি নিশ্চয়ই কতটা যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে গিয়েছিলে সেই অনুভূতি আমাকে দিনরাত তাড়িত করে। আমি অনেক সাহস নিয়ে তোমার কাছে ক্ষমা চাইতে এসেছি, আমার পাপ ক্ষমার যোগ্য নয়, তবুও যদি সম্ভব হয় আমাকে ক্ষমা করে দাও।
গাড়ির ওপাশ থেকে একটা পনেরো বছরের ছেলে ছুটে এলো। উজমার হাত ধরল।
আম্মু, চলো বাসায় যাই।
উজমা হাসিমুখে ছেলের হাত ধরে খুশিতে তার গন্তব্যের দিকে হেঁটে গেল। একবারও সে পেছন ফিরে তাকাল না। মনে মনে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া জানাল, সেদিন হাসপাতাল থেকে ডাক্তার আর নার্স তাকে সাহস না দিলে আজ তার ছেলে সাথে থাকত না।
নুহাশ বিস্মিত ও আবেগী হয়ে সজল চোখে উজমা আর ছেলেকে চলে যেতে দেখল। বুঝতে পারল সে কতটা নগণ্য হয়ে উঠেছে। আজ সে সেই গন্তব্যের সঙ্গীও হতে পারত, কিন্তু স্বার্থপরতার কারণে এই সুখ চিরতরে হারিয়েছে।
আজকালের খবর/আরইউ