মধ্যরাতে যখন হালকা নীল আলোর নিবিড় সময়, চারিদিক নিঝঝুম চুপচাপ; আকস্মিক ক্ষণিকের ঝড় এসে গেল। রামিয়া গভীর ঘুমে স্বপ্ন দেখছিল। সে চোখ মেলে সব বুঝে নেয়। সালিম কিছুতেই শোনে না। সবকিছুতে তাড়াহুড়ো। অবুঝ জেদ। ‘আমার খুব ঘুম পাচ্ছে। পরে।’ সে দ্বিতীয় হাই তোলে।
‘আর কত পরে? আমার ঘুম আসছে না ডিয়ার। কতদিন পরে এলে বলো তো! আমার রামিয়া...রামিয়া।’
সালিম চুক চুক করে দু-গালে দুটো চুমু দেয়। রামিয়া কপট রাগে পুনরায় হেসে ওঠে।
‘এখন তো রামিয়া-রামিয়া বউ-বউ বলতে থাকবে। সকালে বকা দেবে পরোটা বাঁকা হলো কেন? অস্ট্রেলিয়ার ম্যাপ হয়েছে। চা কষা লাগছে ইত্যাদি ইত্যাদি।’
‘সকালের কথা সকালে, এখন অন্যকথা। তুমি আর আমি।’
‘বাইরে কি বৃষ্টি হচ্ছে?’
‘কইন্না তো!’
সন্ধে থেকে আকাশে মেঘ জমেছিল। একটু একটু করে নৈর্ঋত কোণায় ধূসর-কালো মেঘজল। শ্রাবণ মাস। এ সময় নাকি বনে-জঙ্গলে ময়ূর-ময়ূরি মেটিং পর্বে মেতে ওঠে। সালিমের দৃষ্টিতে অদ্ভূত নেশা। রামিয়া একপলক তাকিয়ে কী যেন ভেবে নেয়। একজোট হওয়ার প্রায় ছয় মাস হতে চলেছে। তার নিজের শরীর মনেও কি শিহরন ঝংকার নেই? তারপরও সে বোধকরি ক্লান্ত। একটু নিবিড় ঘুম দরকার। সালিমের আর দোষ কী? প্রায় দু-সপ্তাহ ফিল্ডে ছিল। এই কয়েকটি দিন যেন অনেক অনেক মাস, অনেক বছর; কে জানে কত যুগ। রামিয়াও সতেরো দিন পর ফিরে এলো। সুতরাং তেমন করে কাকে কী বলা যায়। বেডের একপাশে ঘুমিয়ে ছিল সে। তিরিশ কিলোমিটার পথ বাসযাত্রা। ইদানীং বাসে যাওয়া-আসা করতে ভালো লাগে না। সালিম মোটরসাইকেল নিয়ে আসে। এবার আসেনি। খবর পাঠিয়েছিল। রামিয়া সকাল থেকে প্রস্তুতি নিতে থাকে। অনেকদিন পর ঘরে ফেরা। কেমন আছে মনের মানুষ জীবনসাথি? বিয়ের পর এমন তাড়না হয় আগে জানা ছিল না। এসব ভাবনা মুহূর্তের মধ্যে এসে মনে অদ্ভূত অনুরণন সঞ্চার করে যায়।
আজ বাজারের দিন। বাসের জন্য অপেক্ষা করতে করতে দুটো চলে গেল। সিট ফাঁকা নেই। নাজিম উঠিয়ে দিতে এসেছে। অবশেষে সূর্য যখন পশ্চিম আকাশে লাল হয়ে ঢলে যেতে শুরু করে, সে বলে উঠে, -
‘কাল গেলেই ভালো হতো আপা, আজ বাজারের দিন, বাসে খুব ভিড়।’
‘তোর দুলাভাই ফিল্ড থেকে এসেছে। কাল থেকে আবার অফিস। যেতে বলল বারবার, না গেলে রাগ করবে।’
‘তবে আর সময় নষ্ট করা কেন? দুটো বাস চলে গেল। এতক্ষণে বাড়িতে পৌঁছে যেতে।’
এই কথার মধ্যে ছোট এক বাস এসে যায়। সোনার তরী। বাসের মালিক বোধহয় রবীন্দ্রভক্ত। সুন্দর নাম রেখেছে। রামিয়া বাসের ভেতরে এসে দেখে একটি সিটও ফাঁকা নেই। আজ কপাল খারাপ। অবশেষে ইঞ্জিন কভারে বসে শুধু শুধু পেছন গরম করে তোলা। বোনাস হিসেবে কার্বন মনোঅক্সাইডের বিদঘুঁটে ঝাঁজালো গন্ধ। অন্য কেউ হলে বমি করে দিত। রামিয়ার অভ্যেস আছে।
সালিম এবার সিগারেট জ্বালিয়েছে। পুরুষ মানুষের ঠোঁটে সিগারেট নেই ভাবতে কেমন লাগে। রামিয়া একরকম মুগ্ধ দৃষ্টিতে পলকমাত্র তাকিয়ে বাথরুমের দিকে এগিয়ে যায়। সালিমও তাকিয়ে আছে। চোখে চোখ। রামিয়া বুঝতে পারে। একচিলতে দুষ্টু হাসি ঠোঁটে জেগে ওঠে তার। বাইরে বেশ জোর বাতাস। আকাশ অন্ধকার হয়ে আছে। উত্তর কোণায় ইলেকট্রিক পোস্টে একটি বালব মøান আলো ছড়াতে ছড়াতে ক্লান্ত। এর ঠিক দু-চার মিনিট পর ফিসফিস করে ওঠে রামিয়া।
‘কেউ বুঝি গলিতে জানালার কাছে।’
‘জানালা তো বন্ধ করেছি।’
‘কেউ জানালার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। পায়ের শব্দ পেলাম।’
‘দূর...বাতাসে গাছের পাতা নড়ার শব্দ। তুমি সবসময় ডিস্টার্ব করো রামিয়া।’
‘না না ঠিক বলছি। তুমি লাইট অফ করে দাও তো। আমার লজ্জা লাগছে।’
‘লাইট অফ হবে না ডিয়ার। তোমাকে দেখে থাকতে ইচ্ছে করে।’
‘হুম্! তাড়াতাড়ি শেষ করো। ভাল্লাগে না।’
রামিয়ার কথা ঠিক। মেয়েদের ইনট্যুশন ক্ষমতা বেশি। তার ঘরের জানালা দুটো পশ্চিমমুখি। পেছনে চার ফুট দূরে অন্য বাড়ির দেয়াল। কারও যাওয়া আসার জন্য স¦ল্প পরিসরের এই গলিতে কোনো বাধা নেই। সালিম নিজেকে ফ্রি করে নিয়ে যখন পেছনের জানালা দুটো খুলে দেয়, দক্ষিণের জানালার ওপাশে একজোড়া স্যান্ডেল পরে থাকতে দেখে। সুতরাং রামিয়ার কথা ঠিক। কেউ একজন দাঁড়িয়ে ছিল। পুরোনো বাড়ি। কাঠের দরজা-জানালা। এখানে-ওখানে দু-চারটি ছিদ্র থাকা অস্বাভাবিক নয়। কেউ তা হলে সেই ছিদ্র দিয়ে দেখছিল। কে এমন বিকৃতমস্তিষ্ক ব্যক্তি? সে আলগোছে দরজা খুলে বেরোবে, তখন রামিয়া ফিসফিস কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে ওঠে, -
‘কোথায় যাচ্ছ?’
‘তোমার কথা ঠিক, কেউ জানালার পেছনে আমাদের দেখছিল। শালা বাস্টার্ড!’
‘ছি ছি! এখন কি আর আছে? চলে গেছে। তুমি যাবে না। কে জানে ছুরি-টুরি সাথে আছে কি না!’
‘তুমি বড্ড ভিতু! দাঁড়াও না দেখে আসি কোন্ জারুয়া হতে পারে।’
‘কীভাবে চিনবে? বোকা মানুষ কোথাকার! থামো বাইরে যাবে না।’
সালিম কোনো কথা শোনে না। একজোড়া লেদার স্যান্ডেল পড়ে আছে জানালার পেছনে। লোকটি নিঃসন্দেহে পারভার্টেড- মস্তিষ্কবিকৃত এবং এই মহল্লারই একজন হবে, যার কাজ হলো রাতের অন্ধকারে দম্পতিদের ঘরে উঁকি মারা। কে সে? কে হতে পারে? এই ভাবনার মধ্যে আঙিনা পেরিয়ে বাড়ির পেছনে গলি ধরে জানালার কাছে যেতে যেতে কয়েক সেকেন্ড কি একমিনিট, আর দেখে সেই স্যান্ডেল জোড়া গায়েব; তবে কি দেখার ভুল? সে হতে পারে না। সেই লোক নিশ্চয়ই গলি পথে দক্ষিণে পালিয়ে গেছে। সালিম আরও কিছুদূর ভেতরে প্রবেশ করে। সেখানে ঝোপঝাড়, হাজারও নোংরা আবর্জনা, এককথায় ভাগাড়, মহিলাদের পিরিয়ড প্যাডগুলো বীভৎস কালচে-সাদা হয়ে জেগে আছে, ঘুগড় বা উচ্চিংড়ের তারস্বর শব্দ নেই; সামনে আর গিয়ে কী হবে? সে ফিরে আসে। তার অদ্ভূত অনুভূতি হতে থাকে। নিজেকে ন্যাংটো দেখতে কিংবা দেখাতে কোনো সমস্যা নেই, কিন্তু...রামিয়ার দুধসাদা শরীরের সৌন্দর্য! সালিমের প্রচণ্ড রাগ হতে থাকে। হারামজাদাকে একবার ধরতে পারলে দুই গালে কিলো ওজনের থাপ্পড় মেরে শান্ত হতো। মিস হয়ে গেল।
মানুষের স্বভাবের মধ্যে কেউ গর্ধব, কেউ সাপ, কেউ নেউল; এরমধ্যে দু-চারজন কুকুর চরিত্রেরও আছে। মানুষের মধ্যে পশু অথবা বলা যায় পশুর দোষগুণ নিয়ে মানুষ। পশুর আবার গুণ কী? কেন প্রভুভক্ত কুকুর। উপরঅলার কি আজিব কারিশমা! প্রভুভক্ত কুকুর, কিন্তু রাস্তা অলিগলিতে প্রকাশ্যে মেটিং করে। সালিমের নিজেকে তেমন একজন কুকুর মনে হয় সেই রাতে। এখন থেকে ঘরে আলো জ্বালবে না। দরজা জানালা আর দেয়ালে কোথায় কোন্ ছিদ্র আছে সেগুলো সারাতে হবে। অথচ সেই কাজটি আর হয় না। কয়েকদিন মহল্লার সন্দেহভাজন কজন মানুষের পায়ে পায়ে তাকিয়ে সেই স্যান্ডেল মালিককে অনুসন্ধান করে গেল। তারপর সব ভুলে যাওয়া। সে-সব কি আর মনে থাকে? কেমন ডিজাইন স্যান্ডেল সেই নকশাও ধীরে ধীরে আবছায়া ফ্যাকাশে হতে হতে মন থেকে প্রায় মুছে গেল। ঘটনা শুধু উৎকট স্মৃতি হয়ে জেগে রইল। তারপর হাজারও কাজের ফাঁকে কখনো সেই রাত জেগে ওঠে। অফিস শেষে ঘরে ফিরে এলে মনে পড়ে সহসা। জানালার ছিদ্রগুলো পুডিং দিয়ে বন্ধ করা হলো না। রামিয়ার কি মনে পড়ে? একবার জিজ্ঞেস করে দেখবে নাকি? তার ইনট্যুইশন ক্ষমতা বেশি। সে কীভাবে টের পায় এসব?
সেদিন অফিসে কাজ করতে করতে আকস্মিক রাতের ঘটনা মনে পড়ে যায়। অদ্ভুত হতাশা আর রাগ কিছুক্ষণ অস্থির করে তোলে। এইসব মস্তিষ্কবিকৃত মানুষেরা সমাজের শত্রু। এরা জঘন্য। কুৎসিত এদের রুচি। আজকাল অন্তর্জালের দুনিয়া। সেখানে হাজারও ভিডিও। পর্নোগ্রাফি। এই লোকটা এসব দেখে না কেন? অথবা কে জানে সে-সব দেখে দেখেই মাথা পচে গেছে। একবার ধরতে পারলে হারামজাদার দু-চোখ গলিয়ে দেওয়ার সাধ জাগে। সাম্প্রতিকালে কোথাও কোথাও অপরাধের শাস্তি পাবলিক দিয়ে ফেলে। খেজুর কাঁটা কি ফর্কচামচ দিয়ে চক্ষু উৎপাটন, মাথা ফাটিয়ে দেওয়া, হাতের কবজি কর্তন, গণপিটুনি কত কী! এসব অন্যরকম অপরাধ। আইন হাতে তুলে নেওয়া যায় না...উচিত নয়। আগেকার দিনে রাজা-বাদশা-জমিদারেরা অপরাধীর মুখে চুনকালি মাখিয়ে, মাথা ন্যাড়া করে পচা দই বা ঘোল ঢেলে গাধার পিঠে বসিয়ে সারা নগর ঘুরিয়ে পরিচিত করাত। এই আজব দণ্ডবিধানে কোনো লাভ হতো কি না কে জানে, তবে মনে হয় চোর আরো বড় অপরাধীতে পরিণত হয় কিংবা চক্ষুলজ্জায় আত্মহত্যা করে বসে। বড় অপরাধী বলতে ভয়ংকর ডাকাত বা দস্যু। তাদের দল থাকত। আলিবাবা চল্লিশ চোরের গল্প। আইন-বেআইন কিংবা অপরাধ যা হোক কুকুর স্বভাব লোকটাকে একবার পেলে হয়। সালিমের কাজে মনোযোগ থাকে না। মাথা তেতে ওঠে। কয়টি সিগারেট যে পর পর ধরিয়ে শেষ হয় স্মরণে থাকে না। এমন এক ঘটনা কাউকে বলতেও বাধে। অচেনা অস্বস্তিতে অস্থির হয়ে ওঠে মন অকারণ।
তারপর অন্য এক রাত। আকাশে পূর্ণিমা। আলোঝরা মদালসা গভীর। সারাদিন গুমোট গরম শেষে সন্ধের শুরুতে বৃষ্টির হালকা আনাগোনা। কখনো জোর বাতাসে ঝরে পড়ে কখনো থেমে চারিদিক নিশ্চুপ। ছন্দোবদ্ধ কবিতার মতো। স্বস্তির পরশ। গলির শেষমাথার বাড়ির বাগান থেকে ভেসে আসে বাতাবিলেবুর সৌরভ। ঘরের মধ্যেও ফুলেল বিছানা। রামিয়া বেছে বেছে পছন্দ করে কিনেছে। চমৎকার বেডশিট। ফুলে ফুলে লালে লাল। সে চারপাশ দেখেশুনে গুছিয়ে ঘরে এসে মৃদুস্বরে বলে উঠে, -
‘এই লাইট অফ করো। আমি ঘুমোব।’
‘আজ সারারাত আলো জ্বলবে।’
‘কেন? আমি ঘুমোব না? সকাল সকাল উঠতে হয়। তোমার অফিস আছে। আমাকেও যেতে হবে।’
‘তোমার চাকরি হবে বলছ?’
‘কেন হবে না? কত ভালো ভাইভা দিয়েছি। নাম এসেছে শুনলাম। কাল নোটিশ বোর্ড দেখে আসব।’
‘উইশ ইউ গুড লাক।’
সালিম একটু এগিয়ে জড়িয়ে ধরে। সে কোনো কথা শোনে না। রামিয়া বোধকরি তেমনই চায়। তারপর অনেকদিন পর যেভাবে যেমন দুজন কাছাকাছি হতে শুরু করে। তখন আচমকা সেই রাতের স্মৃতি মনে পড়ে যায়। সালিম দু-চারদিন কয়েকজনের পায়ে পায়ে তাকিয়ে সেই স্যান্ডেল খুঁজেছিল। গোয়েন্দা গল্পগুলো মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে। রহস্য উদঘাটনে নোংরা কত কাজ যে করতে হয়! সেই স্যান্ডেল জোড়া চোখে ভেসে ওঠে। আবছায়া রাতে অদ্ভুত জ্বলজ্বল করছিল। খোঁজ পেলে কালপ্রিট ধরা পড়তে বাধ্য। কথায় বলে কান টানলে মাথা আসে। অথচ হারামজাদাকে পাওয়া গেল না। চতুর শয়তান। সেই অস্বস্তি আর ক্ষোভ মনের মধ্যে পুনরায় ডালপালা মেলে দেয়। একসময় তারও মন বলে কেউ বুঝি সত্যি সত্যি জানালার পেছনে দাঁড়িয়ে ঘরের ভেতর তাাকিয়ে আছে। সন্দেহ বড় সাংঘাতিক জিনিস। পিঁপড়ার মতো কামড়াতে থাকে। মশার মতো ভনভন করে। সালিম আকস্মিক আলগোছে বেড থেকে নেমে মেঝেতে দাঁড়ায়। কোথাও কোনোকিছু হয়নি বা হচ্ছে না, ঠিক তেমন সতর্ক পদক্ষেপে একেবারে জানালার কাছে। তারপর...ওপাশ থেকে ‘বাবা গো’ বলে তীব্র চিৎকার ভেসে আসে। এবং দ্রুত পদশব্দ।
সালিম বেশ খুশি মনে হাতে ধরে থাকা সাইকেল স্পোক জানালার পাশে রেখে দেয়। দেয়ালের সাদা রং রক্তে ভিজে লাল। রামিয়া উঠে বসেছে। বোধকরি কোনোকিছু ঠাহর করতে পেরেছে কিংবা পারেনি, ভয়ার্ত চোখে জিজ্ঞাসা তুলে ফিসফিস করে ওঠে, -
‘কেমন চিৎকার শুনলাম...কোথা থেকে এলো বলো তো? আমাদের গলিতে?’
‘কই না তো! আমি কিছু শুনিনি। তোমার কোনো ফোবিয়া ধরেছে মনে হয়। হা হা হা!’
সালিম পুনরায় জড়িয়ে ধরে তাকে। রামিয়া উপরের দিকে দৃষ্টি রেখে কাঁধে চাপ দিয়ে কানে কানে বলে উঠে, -
‘তুমি বধির মানুষ। আমি স্পষ্ট শুনলাম, কেউ খুব জোর চিৎকার করল।’
‘বাদ দাও তো...এসো।’
এর দুদিন পর রাস্তায় দেখা গেল, একজন মানুষ, বাম চোখে ব্যান্ডেজ; আস্তে আস্তে হেঁটে যাচ্ছে। তার নাম নুরল হুদা, ছেলেবেলার খেলার সাথি। বয়সে সিনিয়র কিন্তু বন্ধু তো ছিল। আজকাল তেমনভাবে কথাবার্তা হয় না। কিশোরবেলার বন্ধুরা দিন পেরিয়ে যেতে যেতে বয়স হতে হতে আকস্মিক দূরের হয়ে যায়। কোথাও আবার নতুন ঘনিষ্ঠতা তৈরি হতে থাকে। নিবিড়তা বাড়ে। এই তো জীবন। নুরল হুদার সঙ্গে যোগাযোগ একেবারে অপসৃত ঋতুর মতো, কখনো মনে থাকে, থাকে না; প্রয়োজন কোথায়! একই মহল্লায় বসবাস অথচ কেউ আছে অথবা নেই ভাবনা হারিয়ে গেছে। সালিম অফিস যাওয়ার জন্য বেরিয়েছিল। তখনই দেখা। তার চোখ সেই স্যান্ডেল জোড়া চিনে নিতেও ভুল করে না। সে বাঁ-হাত তুলে রিস্টওয়াচ দেখে এগিয়ে যায়।
‘নুরল হুদা কেমন আছ? চোখে কী হয়েছে?’
‘ছানি অপারেশন করেছি রে।’
‘ও আচ্ছা...এবার বিয়ে করে ফেলো নুরল। সময় তো বয়ে যায়।’
‘করব করব।’
সালিম জানে এই পরামর্শের অর্থ দুর্বোধ্য নয়, কিন্তু সে বুঝবে কি না কে জানে; স্বভাব বড় সাংঘাতিক বস্তু। সহজে পালটানো যায় না। নুরল হুদাকে তো ছোটবেলা থেকে দেখে আসছে। এর-ওর ঘরে কি জানালায় উঁকি দেওয়া স্বভাব। এসব মানুষের শাস্তি তেমনই হয়। নুরল হুদা কি অন্ধ হয়ে যেতে পারে? কে জানে? সম্ভবত নয়। সালিম জোরে আঘাত করেনি। তারপরও মনে হয় এমন করা উচিত নয়। সে আলগোছে ঘর থেকে বেরিয়ে হাতেনাতে ধরার চেষ্টা করতে পারত। করল না কেন? রাগে অন্ধ হয়ে গিয়েছিল? নুরল হুদা যদি এবার সত্যি অন্ধ হয়ে যায়? অন্ধ গলির হাজারও ছিদ্র ভরাট বা নিরসন করা অত্যন্ত দুরূহ কাজ।
সালিম কিছু বিষাদ ভাবনায় সকালের আলোকে ম্লান করে ফেলে।
আজকালের খবর/আরইউ