শিরোনাম: |
স্বমহিমায় উদ্ভাসিত শেখ কামাল
মোতাহার হোসেন
|
![]() দেশ ও সমাজ ভাবনায় শেখ কামাল মাত্র ২৬ বছরের জীবনে বাঙালির সংস্কৃতি ও ক্রীড়াক্ষেত্রে দক্ষ সংগঠক ও অসামান্য মেধায় এবং অনন্য উচ্চতায় প্রতিভার স্বাক্ষর রেখে গেছেন। পাশাপাশি রাজনীতিতেও ছিলেন সক্রিয়। ছোটবেলা থেকেই খেলাধুলার প্রতি ছিল তার প্রবল আগ্রহ। ঢাকার শাহীন স্কুলে পড়াকালীন স্কুলের খেলাধুলার প্রতিটি আয়োজনে তিনি ছিলেন অগ্রভাগে। বলতে গেলে তিনি সকল খেলাধুলার জন্য ছিলেন অপরিহার্য ও অবিচ্ছেদ্য একজন। এরমধ্যে ক্রিকেটের প্রতি আগ্রহ মনোযোগ ছিল সবচেয়ে বেশি। দীর্ঘদেহের অধিকারী শেখ কামাল সফল ফাস্ট বোলার হিসেবে নিজেকে ফুটিয়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য হচ্ছে তারুণ্যের অফুরান শক্তিতে বলীয়ান শেখ কামাল শুধুমাত্র বঙ্গবন্ধুপুত্র হওয়ার কারণে অবিভক্ত পাকিস্তানের জাতীয় পর্যায়ের ক্রিকেটে উপেক্ষিত থেকেছেন। তরুণ বয়সে আজাদ বয়েজ ক্লাবের সাথে যুক্ত হয়েছিলেন এবং ওই ক্লাবের হয়েই দীর্ঘদিন প্রথম বিভাগ ক্রিকেট খেলেছেন। ঢাকার আজাদ বয়েজ ক্লাব তখন প্রতিভাবান তরুণ ক্রিকেটারদের অন্যতম ঠিকানা। খেলাধুলার পাশাপাশি সংস্কৃতিচর্চার প্রতি তার আগ্রহ ও কর্মকাণ্ডের ব্যাপকতা তার প্রতিভা ও মননের এক বিশাল দিককে উন্মোচিত করে। অভিনয়, সংগীত চর্চা, বিতর্ক, উপস্থিত বক্তৃতাসহ সকল ক্ষেত্রে তিনি তার মেধার স্বাক্ষর রেখেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হয়ে সলিমুল্লাহ হলের ছাত্র হিসেবে হলের বাস্কেটবল টিমের ক্যাপ্টেন ছিলেন শেখ কামাল। বাস্কেটবলে তার অসামান্য দক্ষতার কারণে তার সময়ে বাস্কেটবলে সলিমুল্লাহ হল শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করতে সক্ষম হয়। স্বাধীনতা পরবর্তী আবাহনী ক্রীড়াচক্র প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের ক্রীড়াক্ষেত্রে এক যুগান্তকারী বিপ্লবের সূচনা করেন শেখ কামাল। তার নেতৃত্বে ওই সময়ের প্রতিষ্ঠিত ও জনপ্রিয় ক্লাব মোহামেডানকে পেছনে ফেলে আবাহনীকে তিনি গৌরবের উচ্চ আসনে অধিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। ক্রমান্বয়ে সারাদেশে আবাহনীর শাখা গঠনে তৎপর হন। তরুণ সমাজের চিত্তের প্রফুল্লতা নিশ্চিত করা ও বিপথে ধাবিত হওয়া থেকে বিরত রাখতে খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক জাগরণের প্রয়োজনীয়তা, গুরুত্ব তিনি উপলদ্ধি করেছেন সবসময়। তাই মাত্র ২৬ বছরের স্বল্পকালীন জীবনে তাকে সে অনুযায়ী নানমুখি উদ্যোগ নিতে দেখা যায়। বিশেষ করে সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড-সংস্কৃতি চর্চাকে এগিয়ে নিতে বন্ধু, সতীর্থ শিল্পী ও সহকর্মীদের নিয়ে গড়ে তুলেছিলেন ‘স্পন্দন শিল্পীগোষ্ঠী’। ছাত্রলীগের কর্মী ও সংগঠক হিসেবে তিনি ছয় দফা, ১১ দফা আন্দোলন এবং ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানে বীরোচিত ও সাহসী অংশগ্রহণ ছিল তার। অসামান্য সাংগঠনিক দক্ষতার অধিকারী শেখ কামাল সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম ওয়ার কোর্সে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হয়ে মুক্তিবাহিনীতে কমিশন্ড লাভ করেন এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি জেনারেল এমএজি ওসমানীর এডিসি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের সদস্য ছিলেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে ষড়যন্ত্রকারীদের পৈশাচিক হামলায় নিহত হওয়ার সময় তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানের এমএ শেষপর্বের পরীক্ষার্থী ছিলেন। এর মাত্র এক মাস আগে ১৯৭৫ সালের ১৪ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্লু খেতাবপ্রাপ্ত দেশসেরা অ্যাথলেট সুলতানা খুকুকে তিনি পারিবারিকভাবে বিয়ে করেন। পঁচাত্তরের ১৫ আগস্ট নারকীয় হত্যাযজ্ঞের প্রধান লক্ষ্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলেও এ দিনের ঘটনায় প্রথম শহীদ হন তার জ্যেষ্ঠপুত্র শেখ কামাল। বঙ্গবন্ধুর ছেলে পরিচয় দেওয়ার পর মেজর (বরখাস্ত) বজলুল হুদা তার স্টেনগান দিয়ে বঙ্গবন্ধুর বড় ছেলে শেখ কামালকে হত্যা করে। বঙ্গবন্ধু বাড়ির অন্যতম পাহারাদার হাবিলদার কুদ্দুস সিকদারের আদালতে দেয়া সাক্ষ্য থেকে জানা যায়, বাড়িতে প্রথম প্রবেশ করে বজলুল হুদা এবং ক্যাপ্টেন (বরখাস্ত) নূর চৌধুরী। সঙ্গে আরো কয়েকজন। বাড়িতে ঢুকেই তারা শেখ কামালকে দেখতে পায়। সাথে সাথে বজলুল হুদা স্টেনগান দিয়ে তাকে গুলি করে। শেখ কামাল বারান্দা থেকে ছিটকে গিয়ে অভ্যর্থনা কক্ষের মধ্যে পড়ে যান। সেখানে তাকে আবার গুলি করে হত্যা করা হয়। বঙ্গবন্ধু ভবনের আবাসিক ব্যক্তিগত সহকারি এবং হত্যা মামলার বাদী মোহিতুল ইসলামের প্রত্যক্ষ সাক্ষ্যের মধ্যের এই বর্ণনা রয়েছে। মোহিতুল ইসলাম ১৯৭২ সনের ১৩ ডিসেম্বর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ে সহকারি হিসেবে চাকরিতে যোগ দেন। তিনি ১৯৭৫ সনে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রেসিডেন্ট পিএ-কাম-রিসেপশনিস্ট ছিলেন। মোহিতুল ইসলাম তার সাক্ষ্যে শেখ কামালের হত্যা নিয়ে বলেন, ‘তখন ভোর সাড়ে ৪টা-৫টা হবে। চারদিক ফর্সা হয়ে গেছে। বাড়ির চারদিকে বৈদ্যুতিক আলোও জ্বলছিল। বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে তখন গোলাগুলি শুরু হয়ে গেছে। কিছুক্ষণ পর গুলি বন্ধ হলে কাজের ছেলে আবদুল ওরফে সেলিম ওপর থেকে পাঞ্জাবি-চশমা এনে দিলে বঙ্গবন্ধু ওই পাঞ্জাবি চশমা পরে বারান্ধায় এসে ‘আর্মি সেন্ট্রি, পুলিশ সেন্ট্রি এত গুলি হচ্ছে তোমরা কী কর’ বলে উপরে চলে যান। এর মধ্যে খাকি পোশাকধারী বজলুল হুদা শেখ কামালের পায়ে গুলি করে। শেখ কামাল তখন শেখ মুজিবের ছেলে পরিচয় দিলে সঙ্গে সঙ্গে শেখ কামালকে ব্রাশফায়ার করে হত্যা করা হয়। বজলুল হুদা যে শেখ কামালকে হত্যা করেছিল তার একটি সংক্ষিপ্ত বর্ণনা পাওয়া লেখক মহিউদ্দিন আহমদের ‘৩২ নম্বর পাশের বাড়ি-২৫ মার্চ ১৫ আগস্ট’ গ্রন্থে। এতে বাতেন নামে একজনকে হুদা মুজিব হত্যার যে বিবরন দেন তাই উদ্ধৃত করা হয়েছে। হুদার ভাষ্যমতে, ধানমন্ডিতে শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়িতে বরখাস্ত মেজর নূরের নেতৃত্বে বজলুল হুদারা আক্রমণ চালান। গোলাগুলির শব্দ শুনে শেখ কামাল বেরিয়ে আসেন। হুদা তৎক্ষণাৎ তাকে গুলি করে হত্যা করে। তৎকালীন সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল শফিউল্লাহকে বাড়ি আক্রমণের পর বঙ্গবন্ধু টেলিফোনে যা বলেছিলেন তাতেও এর সত্যতা পাওয়া যায়। ১৯৮৭ এবং ১৯৯৩ সালে একটি জাতীয় দৈনিকে দুটি সাক্ষাৎকারে শফিউল্লাহ বলেছেন, বাড়ি আক্রমণের পর বঙ্গবন্ধু জলদি ফোর্স পাঠানোর জন্য তাগিদ দিয়ে তাকে ফোন করেছিলেন। বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘শফিউল্লাহ তোমার ফোর্স আমার বাড়ি এটাক করেছে। কামালকে বোধ হয় মাইরা ফেলছে। তুমি জলদি ফোর্স পাঠাও।’ প্রবাসী লেখক ও গবেষক গোলাম মুরশিদ ‘মুক্তিযুদ্ধ ও তারপর’ গ্রন্থে এ বিষয়ে বিষদ বিবরণ দিয়েছেন। শেখ কামাল নিহত হওয়ার পর মহিউদ্দিন ও তার সঙ্গীরা বাড়ির ভেতরে ঢুকে মুজিবকে খুঁজতে থাকে। শেষে তার দেখা পায় সামনের বারান্দায়। সাহসের প্রতিমূর্তি মুজিব দাঁড়িয়ে আছেন প্রশান্তভাবে-হাতে পাইপ। ঘাতকের বুলেটে মুখ থুবড়ে বঙ্গবন্ধু লুটিয়ে পড়েন সিঁড়িতে। তখনো তার ডান হাতে ধরা পাইপ। কয়েকটা গুলি তার বুকের ডান দিকে এবং পেটে লেগেছিলো। ফলে, যখন সূর্য ওঠার কথা, সেই সূর্য ওঠার সময় বঙ্গের গৌরব-রবি গেলো অস্তাচলে। এর পর এতে একে শেখ রাসেল, শেখ নাসের এবং বাড়ির এক ভৃত্যকে নিচে নিয়ে যায়। শোবার ঘরে গিয়ে বেগম মুজিব, শেখ জামাল এবং কামাল ও জামালের সদ্য বিবাহিত স্ত্রীদের হত্যা করে। নিচে নিয়ে গিয়ে ঘাতকরা রাসেলকে তার মায়ের কাছে নিয়ে যাওয়ার নাম করে একেবারে কাছ থেকে গুলি করে তাকে হত্যা করে। আজ শেখ কামাল বেঁচে থাকলে তার বয়স হতো ৭৩ বছর। কিন্তু ঘাতকরা তাকে বেঁচে থাকতে দিলেনা। ঘাতকরা সেদিন শুধু একজন ব্যক্তি শেখ কামালকে হত্যা করেনি একইসঙ্গে এক অনন্য সাধারাণ রাজনীতিক, দক্ষ সংগঠক, ক্রীড়াবিদ, সাংস্কৃতিক সংগঠক বহুমুখী প্রতিভাধর ব্যক্তির সেবা ও কর্মগুণ থেকে জাতিকে বঞ্চিত করা হয়েছে। আজকের এদিনে তার বেদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনার পাশাপাশি তার আদর্শের বাস্তবায়ন, অনুসরন করার মধ্য দিয়েই তাকে, তার মেধা প্রতিভাকে সম্মান, মূল্যায়ন করা হবে। মোতাহার হোসেন : সাংবাদিক, সাধারণ সম্পাদক-বাংলাদেশ ক্লাইমেট চেঞ্জ জার্নালিস্ট ফোরাম। আজকালের খবর/আরইউ |