দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আর বাকি মাত্র দেড় বছর। ইতোমধ্যে দেশের প্রধান রাজনৈতিক জোট আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন ১৪ দলীয় জোট এবং বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট তাদের নিজ নিজ রাজনৈতিক সাংগঠনিক তৎপরতা বৃদ্ধি করেছে।
আওয়ামী লীগ দলের জাতীয় সম্মেলনকে সামনে রেখে জেলা, মহানগর, উপজেলা ও থানা শাখার সম্মেলনকে সফল করতে কাজ করে যাচ্ছে। সাংগঠনিক কার্যক্রম জোরদারের মূল লক্ষ্য হলো আগামী জাতীয় নির্বাচনে দলকে টানা চতুর্থবারের মতো ক্ষমতায় নিয়ে আসা।
অপরদিকে বিএনপি তাদের চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার মুক্তি ও বিদেশে চিকিৎসার দাবিতে আন্দোলন গড়ে তোলার চেষ্টা করছে। তারা বৃহৎ পরিসরে সরকারবিরোধী আন্দোলন গড়ে তুলতে তাদের জোট ছাড়াও বাইরে থাকা বেশ কিছু রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করছে। নাগরিক ঐক্য, গণসংহতি আন্দোলনসহ বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বিএনপির সংলাপ অনুষ্ঠিত হয়েছে।
অনেকেই ধারণা করছেন, আগামী নির্বাচন বেশ প্রতিদ্বনিদ্বতাপূর্ণ হবে। কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের ভোটের ফলাফল দেখে সেটাই মনে হয়। কারণ বিএনপির দুজন প্রার্থী না থেকে একজন প্রার্থী থাকলে তাদের আরো ব্যাপক ভোটের ব্যবধানে জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা ছিল। কারণ কুমিল্লায় বিএনপি-জামায়াতের ভোটের পরিমাণ আওয়ামী লীগের চেয়ে বেশি।
কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের ভোটের ফলাফলকে আওয়ামী লীগ বিবেচনায় নিলে চলমান উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডসহ অন্যান্য রাজনৈতিক বিষয়গুলোকেও বিবেচনায় নিতে হবে। কারণ শুধু উন্নয়ন কর্মকাণ্ড দিয়ে আগামী জাতীয় নির্বাচনে নির্বাচনী বৈতরণী পার করা আওয়ামী লীগের জন্য দুরূহ হয়ে পড়বে।
দেশের মোট ভোটারের প্রায় অর্ধেক নারী। নারী ভোটাররা বিএনপি-জামায়াতের চেয়ে আওয়ামী লীগকেই বেশি পছন্দ করে থাকে। তাই নারীদের বেশিরভাগ ভোট আওয়ামী লীগ পেয়ে থাকে। দেশের শিক্ষিত ও সচেতন নারীরা জানেন, জামায়াতে ইসলামীর মতো একটি মৌলবাদী রাজনৈতিক দল ক্ষমতায় এলে, নারীরাই সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কারণ, মৌলবাদী এই দলটি ক্ষমতায় এলে নারীদের স্বাধীনতা ও কাজের পরিধি অনেক ক্ষেত্রেই সংকুচিত হয়ে আসবে। সে বিষয়টি বিবেচনায় নিয়েই নারীরা সবসময় আওয়ামী লীগকেই তাদের আস্থার রাজনৈতিক দল হিসেবে বিবেচনা করে এসেছে। কিন্তু গত এক দশকে এই চিত্র পাল্টে গেছে। কারণ জামায়াতে ইসলামী তাবলিগের নামে দেশের পশ্চাৎপদ জেলাগুলোতে ব্যাপক কার্যক্রম পরিচালনা করেছে। বোরকা পরিধান, ইসলামি শরিয়ত প্রতিপালনসহ নানা কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে নারীদের মধ্যে ধর্মীয় উগ্রতার বিস্তার ঘটিয়েছে।
নির্বাচন কমিশনে ছবিযুক্ত পরিচয়পত্র নিতে দেশের বেশ কয়েকটি জেলার কিছুসংখ্যক নারী অনিচ্ছা প্রকাশ করেছে। নির্বাচন কমিশন এ বিষয়ে সুশীল সমাজের কাছে সাহায্যও চেয়েছে। কিন্তু কোনো ফলাফল পাওয়া যায়নি। আওয়ামী লীগ এ ক্ষেত্রে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছে। কারণ, মহিলা আওয়ামী লীগ, যুব মহিলা লীগের মতো সংগঠন নারীদের এ বিষয়ে সচেতন করতে পারেনি। তারা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড, বিশেষ করে এমপি, মন্ত্রী হওয়া ও সরকারি সুযোগ-সুবিধা লাভের মাধ্যমে আর্থিকভাবে সুবিধা নিতেই বেশি ব্যতিব্যস্ত ছিলেন। আর মহানগর, জেলা, উপজেলা, থানা, পৌরসভা ও ইউনিয়নে আওয়ামী লীগসহ সহযোগী সংগঠনগুলোতে নারীবিষয়ক যে সম্পাদকীয় পদ রয়েছে সেগুলোতে মন্ত্রী, এমপি, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকদের স্ত্রী, মেয়ে বা শ্যালিকাদের পদায়ন করা হয়েছে। আর জেলা, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদের নির্বাচিত সংরক্ষিত নারী প্রতিনিধিদের বেলাতেই একই চিত্র দেখতে পাওয়া যায়। আর নির্বাচন কমিশনের দেওয়া ৩৩ শতাংশ নারী প্রতিনিধিত্বে বিষয়েও আওয়ামী লীগ খুব একটি গুরুত্ব দেয়নি বলে মনে হয়।
২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতায় আসার পর নারীসহ সমাজের পিছিয়ে পড়া অংশকে সমাজের মূল স্রোতে আনতে নানা ধরনের ব্যাপক কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। যা বাংলাদেশের মতো একটি দেশের জন্য খুবই কঠিন কাজ। গর্ভবর্তী মায়েদের ভাতা, স্বামী পরিত্যক্তা নারীদের ভাতা, বয়স্ক নারীদের ভাতাসহ বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছে। এসব কর্মসূচির মাধ্যমে সমাজের পিছিয়ে পড়া নারীরা যে ব্যাপকভাবে উপকৃত হয়েছে, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু এই ভাতা বিতরণে কতটুকু স্বচ্ছতা মেনে চলা হয়েছে, সে বিষয়ে সন্দেহ তোলার অবকাশ রয়েছে। কারণ স্থানীয় পর্যায়ের দলীয় নেতাকর্মীরা এসব ভাতা বিতরণে কোনো ধরনের আর্থিক অনিয়মের আশ্রয় নিয়ে থাকলে সেখান থেকে ভালো কোনো ফলাফল পাওয়ার আশা করা দুরূহ ব্যাপার। কারণ যারা এ ধরনের ভাতা গ্রহীতা, তারা যত কম পরিমাণের টাকা দিয়েই থাকুক না কেন, সে টাকা ঋণ বা ধার করেই দিতে হয়েছে। আর যারা টাকা-পয়সা দিয়ে এই ভাতা গ্রহণ করেছেন তারা সরকারের কল্যাণ কর্মসূচির কোনো মূল্যায়ন করবেন না। তারা বিগত সরকারগুলোর চেয়ে বর্তমান সরকারের এই কর্মসূচিকে ব্যতিক্রম কোনো কিছু মনে করবেন না। আর আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরাও এই কর্মসূচিগুলো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ কর্মসূচি তা প্রচার করতে ব্যর্থ হয়েছে।
এদিকে নতুন ভোটাররাও আগামী জাতীয় নির্বাচনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। কারণ তারা বাংলাদেশকে কেমন দেশ দেখতে চায়, তাদের কর্মসংস্থানের সুযোগ কতটুকু রয়েছে, রাজনীতিতে তাদের অংশ গ্রহণের সুযোগ কতটুকু রয়েছে, সে বিষয়গুলো তরুণ ভোটারদের ব্যাপকভাবে আকৃষ্ট করবে। এক্ষেত্রে অন্য দলগুলোর চেয়ে আওয়ামী লীগ এগিয়ে থাকবে। কারণ ছাত্রলীগের রাজনীতি এখনো সকল শিক্ষার্থীর জন্য উন্মুক্ত রয়েছে। আর দেশের নিম্নবিত্ত, নিম্ন মধ্যবিত্ত ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষের জন্য আওয়ামী লীগ যেমন পছন্দসই রাজনৈতিক দল, তেমনি কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া তাদের সন্তানদের জন্যও ছাত্রলীগ পছন্দসই ছাত্র সংগঠন।
লক্ষ্যণীয়, দেশে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন বাস্তবায়ন করার জন্য যারা লাল মলাটের বড় বড় বই পড়েন ও বড় বড় তাত্ত্বিক বুলি আওড়ান, তাদের বেশিরভাগই উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তান। তারা মূলত দেশের গরিব শ্রমজীবী মানুষকে শ্রেণিসচেতন করে বিপ্লবের মাধ্যমে সমাজ বদলের স্বপ্নে বিভোর, তারা তাদের পৈতৃক সম্পত্তি নির্বিঘ্ন করতেই মূল ধারার দুটি রাজনৈতিক বলয়ের বাইরে তৃতীয় একটি বলয় তৈরি করতে চান। যে রাজনৈতিক দলই ক্ষমতায় আসুক তারা সবচেয়ে নিরাপদ ও সুবিধাভোগী।
জামায়াতে ইসলামীর ছাত্র সংগঠনের কথা বাদ দিলাম। কারণ তারা কখনো ক্ষমতাসীন দলের ছত্রছায়া ছাড়া রাজনীতি করতে পারেনি। আর তারা দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমিতায় বিশ্বাসী নয়। কারণ তারা মুক্তিযুদ্ধের সময় যে অপরাধ করেছে, সে অপরাধের জন্য তারা এখনো ক্ষমা চায়নি। তাই দেশের নতুন ভোটাররা বিশেষ করে নিম্ন ও নিম্নমধ্যবিত্ত শ্রেণির পরিবারের সদস্যরা আওয়ামী লীগকেই বেছে নেবেন।
আগামী জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের জন্য সবচেয়ে ভয়ংকর হয়ে দাঁড়াবে দলটির ভেতরে জামায়াত, বিএনপিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল থেকে ওই দলগুলোর সিদ্ধান্ত অনুযায়ী অনুপ্রবেশকারী নেতাকর্মীরা। কারণ তারা তো আওয়ামী লীগ যাতে নির্বাচনে জয়লাভ করে সেজন্য কাজ করবেই না, বরং দলের ত্যাগী ও অপেক্ষাকৃত দুর্বল নেতাকর্মীদের ওপর বিভিন্নভাবে অত্যাচার নির্যাতন চালাবে। দলীয় কোন্দলের নামে ত্যাগী নেতাকর্মীদের ওপর হামলা চালাবে। বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে ভেতরে ভেতরে যোগসাজশ করে আওয়ামী লীগের ত্যাগী নেতাকর্মীদের সঙ্গে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করে, তাদেরকে নিষ্ক্রিয় করে দেবে। আর আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্তের মাদ্যমে এই সংকট মোকাবিলা করতে ব্যর্থ হলে আগামী নির্বাচনে চরম মূল্য দিতে হবে। এই সংকট সমাধানে দলীয় অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণ নির্ধারণ করে, এ ধরনের সংকট বিদ্যমান থাকলে তাকে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিতে হবে। যাতে অনুপ্রবেশকারীরা এ ধরনের সংকট তৈরির সুযোগ না পায়। প্রশাসনে নিয়োজিত কর্মকর্তাদের বিষয়েও সচেতন থাকতে হবে।
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে একটি বিষয় ভালোভাবে উপলব্ধি করতে হবে, তা হলো দল দীর্ঘ ১৪ বছর ধরে ক্ষমতায়। আওয়ামী লীগের যেমন ভালো কাজ রয়েছে, তেমনি দুয়েকটি যে ভুল কাজ হয়নি সেটা বলা যাবে না। আর আশা করি, এই সত্যটুকু স্বীকার করতে আওয়ামী লীগ কখনো কার্পণ্য করবে না। আর মানুষের আরো একটি সহজাত প্রবণতা হলো পরিবর্তন দেখতে চায়, সেটা হোক যৌক্তিক বা অযৌক্তিক। আর বাঙালি জাতি হিসেবে এই পরিবর্তন প্রবণতাটা আরো বেশি। পরশ্রীকাতরতার কথা না হয় বাদই দিলাম। তাই আগামী নির্বাচন যে চ্যালেঞ্জিং হবে তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
আওয়ামী লীগের সবচেয়ে স্বস্তির কারণ হলো দলটি দেশের সশস্ত্র বাহিনীর সঙ্গে নিজের সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটাতে সক্ষম হয়েছে। এখন তারা আর আওয়ামী লীগকে নিজেদের শত্রু মনে করে না। কারণ পকিস্তান আমলের আমলা থেকে শুরু করে সামরিক বাহিনীর সদস্য, পুলিশ সহ সকল সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী যারা মহান মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করেননি, তারা আওয়ামী লীগকে শত্রু মনে করত। কারণ যে সকল কর্মকর্তা-কর্মচারী মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল, তারা নিজেদের মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়াদের থেকে বিশেষ শ্রদ্ধা ও সুযোগ সুবিধা প্রত্যাশা করত। আর বঙ্গবন্ধু সরকারের ভেতরে মুক্তিযুদ্ধে অংশ না নেওয়া সরকারি-কর্মকর্তা কর্মচারীরাই সরকারকে অস্থিতিশীল করে তুলেছিল। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার সঙ্গেও তারা কোনো না কোনোভাবে জড়িত ছিল। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতি অনেকটাই পাল্টে গেছে। কারণ পাকিস্তান আমলের অধিকাংশ কর্মকর্তা-কর্মচারী অবসরে চলে গেছে। সামরিক বাহিনীতেও পাকিস্তান ফেরত কর্মকর্তাদের প্রভাব কমে গেছে। বর্তমান প্রজন্মেও সামরিরক বাহিনীর সদস্যরা আওয়ামী লীগকে আর বিরূপভাবে দেখে না। কারণ তারা উপলদ্ধি করতে পেরেছে যে আওয়ামী লীগ সশস্ত্র বাহিনীর প্রতি বিরূপ দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করে না। আর আওয়ামী লীগ সরকার সামরিক বাহিনীর আধুনিকায়নে সবচেয়ে বেশি অবদান রেখেছে। এতে তাদের আওয়ামী লীগের প্রতি আস্থা গড়ে উঠেছে। যা আওয়ামী লীগের একটি বড় সফলতা।
আওয়ামী লীগের বড় ভোটব্যাংক হলো দেশের শ্রমজীবী গরীব মানুষ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার নিজস্ব প্রজ্ঞার মাধ্যমে বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে এই ভোট ব্যাংক অটুট রাখতে সমর্থ হয়েছে। পাশাপাশি যুক্ত হয়ে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড। পদ্মাসেতু নির্মাণ, মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, মাতারবাড়ি কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্র, কর্ণফুলী ট্যানেলসহ বিভিন্ন কর্মকাণ্ড আওয়ামী লীগকে নির্বাচনী বৈতরণী পার করতে সহায়তা করবে। তবে যুদ্ধাপরাধের বিচার, মুক্তিযুদ্ধে বিরোধিতাকারী বিভিন্ন দেশ এবং পররাষ্ট্রনীতির পরিবর্তনে নাখোশ দেশগুলোর কর্মকাণ্ড সম্পর্কেও সচেতন থাকতে হবে।
লেখক: সদস্য সচিব, বঙ্গবন্ধু সাংবাদিক পরিষদ।
আজকালের খবর/আরইউ