এইচআইভি (Human
Immunodeficiency Virus) ভাইরাস। যাতে আক্রান্ত হয়ে যে রোগটি হয় তার নাম এইডস (Acquired
Immuno Deficiency Syndrome)। মিয়ানমারের বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে শুধু জনসংখ্যার বোঝা হয়েই নয়, সন্ত্রাস, মাদক, মানব পাচার এমনকি স্বাস্থ্যক্ষেত্রেও বড় ঝুঁকি বয়ে এনেছে। তাদের আশ্রয় দেওয়ার পর থেকে কক্সবাজার জেলায় প্রতি বছরই বাড়ছে এইচআইভি শনাক্তের সংখ্যা। সরকারি হিসাবে ২০২০ সালের নভেম্বর থেকে ২০২১ সালের অক্টোবর পর্যন্ত দেশে নতুন করে এইচআইভি শনাক্ত হয়েছেন ৭২৯ জন। এর মধ্যে রোহিঙ্গা শরণার্থী ১৮৮ জন। নতুন শনাক্তের ২৫ শতাংশের বেশি রোহিঙ্গা। ফলে ২০৩০ সালের মধ্যে দেশকে এইচআইভি বা এইডস মুক্ত করার সরকারি ঘোষণা ভেস্তে যাওয়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক ও টিবি-লেপ্রোসী ও এইডস/এসটিডি প্রোগ্রামের লাইন ডিরেক্টর ডা. মো. খুরশীদ আলম আজকালের খবরকে বলেন, বর্তমান বাংলাদেশে এইডস রোগীর সংখ্যা বাড়ার অন্যতম কারণ রোহিঙ্গারা। এ জনগোষ্ঠীর মধ্যে কোনো স্বাস্থ্য সচেতনতা নেই। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে প্রতি বছর যেভাবে এইডস শনাক্ত মানুষের সংখ্যা বাড়ছে, তা রীতিমতো উদ্বেগজনক। রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে স্বাস্থ্য সচেতনতার জন্য আরো প্রচারাভিযান দরকার বলে তিনি মন্তব্য করেন।
কক্সবাজার জেলা প্রশাসন ও সিভিল সার্জন অফিস সূত্রে জানা গেছে, ২০১৭ সালে পুরো জেলায় এইডস আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ছিল মাত্র ১৩২ জন। ২০১৭ সালে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়ার পর কক্সবাজারে বাড়তে থাকে এইডস আক্রান্ত রোগীরা সংখ্যা। ২০২০ সালের অক্টোবর পর্যন্ত কক্সবাজার জেলায় এইডস আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ছিল ৬৮১ জন। যার মধ্যে ৪২৫ জনই রোহিঙ্গা। গত এক বছরে বাংলাদেশে নতুন শনাক্ত ৭২৯ জন এইডস রোগীর মধ্যে রোহিঙ্গা শরণার্থী ১৮৮ জন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের প্রতিবেশী দেশ ভারত ও মিয়ানমার অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ এইচআইভি অঞ্চল হিসেবে বিশ্ব স্বাস্থ্য
সংস্থার প্রতিবেদনেও বলা হয়েছে। বাংলাদেশের সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলায় ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলের ‘পেটের’ মধ্যে থেকেও বাংলাদেশ সবচেয়ে কম ঝুঁকিপূর্ণ দেশের তালিকায় রয়েছে। তবে নতুন আতঙ্ক রোহিঙ্গরা। মিয়ানমার থেকে আসা এই জনগোষ্ঠীর বিপুলসংখ্যক মানুষ এরই মধ্যে এইডস শনাক্ত হয়েছে। গত এক বছরে দেশে নতুন আক্রান্তদের ২৫ শতাংশের বেশি রোহিঙ্গা। ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে এইডসমুক্ত করার সরকারি ঘোষণা কঠিন চ্যালেঞ্জ। চ্যালেঞ্জ উত্তোরণে রোহিঙ্গা ক্যাম্পসহ সারা দেশে আক্রান্তদের চিকিৎসার পাশাপাশি এইচআইভি টেস্টিং অ্যান্ড কাউন্সিলিং, পজিটিভ লিভিং কাউন্সিলিং, পুষ্টি ও নিরাপদ যৌন উপকরণ বিনামূল্যে বিতরণসহ নানা কর্মসূচির ওপর জোর দিতে হবে।
জানতে চাইলে কক্সবাজার জেলা সিভিল সার্জন ডা. মাহাবুবুর রহমান বলেন, রোহিঙ্গাদের মধ্যে হঠাৎ এইডস আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বাড়ছে তা বলা যাবে না। ২০১৭ সালের আগস্ট মাসে মিয়ানমার থেকে যখন আসে, তখনই হয়তো অনেকে আক্রান্ত ছিলেন। তখন ডায়াগনসিস হয়নি। পরবর্তীতে ডায়াগনসিস করায় শনাক্ত হয়েছে। রোহিঙ্গারা পর্দানশীন। যৌনমিলনে যেসব বেরিয়ার মেথড মেনে চলার কথা, সে ক্ষেত্রে তাদের চরম অনীহা রয়েছে। আক্রান্ত কমিয়ে আনার ক্ষেত্রে করণীয় বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, স্বাস্থ্যবিধি মেনে যৌন মিলনে সচেতনতা বাড়াতে আমরা কাজ করছি। সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন এনজিও কাজ করছে। যৌনমিলনে বেরিয়ার মেনে চলা, বিশ^স্ত যৌনসঙ্গী নির্বাচন এসব বিষয়ে জোর দিতে হবে। ডায়াগনসিস বাড়তে হবে। শনাক্ত হওয়ার পরে আইসোলেশনে নিয়ে চিকিৎসা করাতে হবে। এসব কার্যক্রম জোরদার করা হলে শনাক্ত কমবে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সূত্র জানিয়েছে, বাংলাদেশে প্রথম এইচআইভি শনাক্ত হয় ১৯৮৯ সালে। ১৯৮৯ সাল থেকে এখন পর্যন্ত মোট এইচআইভি আক্রান্ত শনাক্ত হয়েছেন আট হাজার ৭৬১ জন এবং মারা গেছেন এক হাজার ৫৮৮ জন। দেশে গত এক বছরে মোট এইচআইভি পরীক্ষা করা হয়েছে ছয় লাখ ২৮ হাজার ৩১২ জনের। এছাড়া ব্লাড স্ক্রিনিং করা হয়েছে আরো ছয় লাখ ৬২ হাজার ৭৫৭ জনের। বাংলাদেশে সাধারণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে এইচআইভি সংক্রমণের হার ০.০১ শতাংশের নিচে। তবে ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠীর মধ্যে এই সংক্রমণ কিছুটা বেশি। দেশে সম্ভাব্য এইচআইভি আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ১৪ হাজার।
দেশে গত এক বছরে নতুন আক্রান্ত ৭২৯ জনের মধ্যে রোহিঙ্গা ১৮৮ জন (২৬ শতাংশ), বিদেশফেরত প্রবাসী ও তাদের পরিবারের সদস্য ১৪৪ জন (২০ শতাংশ), ইনজেকশনের মাধ্যমে শিরায় মাদক গ্রহণকারী ৬১ জন (আট শতাংশ), নারী যৌনকর্মী ১৭ জন (দুই শতাংশ), সমকামী ৬৭ জন (৯ শতাংশ), পুরুষ যৌনকর্মী ৫৩ জন (সাত শতাংশ) ও ট্রান্সজেন্ডার ১৩ জন (দুই শতাংশ)।
নতুন আক্রান্ত ৭২৯ জনের মধ্যে চিকিৎসাসেবার (এন্টি রেট্রোভাইরাল থেরাপি) আওতায় এসেছেন ৬৪২ জন। এইচআইভি পরীক্ষা ও চিকিৎসা (অ্যান্টি রেট্রোভাইরাল ড্রাগ) সম্পূর্ণ বিনামূল্যে দিয়েছে সরকার। দেশব্যাপী ১১টি সরকারি হাসপাতাল থেকে এইডস আক্রান্ত রোগী চিকিৎসা (এআরভি) সুবিধা পাচ্ছেন। এ ছাড়া দেশব্যাপী ২৮টি সরকারি হাসপাতালের এইচআইভি পরীক্ষা সেন্টার থেকে বিনামূল্যে এইচআইভি পরীক্ষা করা হচ্ছে। এসব এইচআইভি পরীক্ষা কেন্দ্রে যেকোনো ব্যক্তি সম্পূর্ণ বিনামূল্যে এইচআইভি পরীক্ষা করতে পারেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, দেশে ইউনিসেফের সহায়তায় মায়ের থেকে শিশুর এইচআইভি সংক্রমণ প্রতিরোধে ১৩টি সরকারি হাসপাতাল চালু আছে। পিএমটিসিটি কার্যক্রমের আওতায় গত এক বছরে এইচআইভি টেস্ট হয়েছে এক লাখ ১৩ হাজার ২১৯ জনের। এক বছরে ২১ জন গর্ভবতী নারী এইচআইভি পজিটিভ শনাক্ত হয়েছেন। পুরাতন ও নতুন মিলিয়ে গত এক বছরে ৭২ জন পিএমটিসিটি সেবা নিচ্ছেন। এআরটি নিচ্ছেন ৭২ জন গর্ভবতী নারী।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক ও টিবি-লেপ্রোসী ও এইডস/এসটিডি প্রোগ্রামের লাইন ডিরেক্টর ডা. মো. খুরশীদ আলম বলেন, দেশে সম্ভাব্য এইচআইভি আক্রান্ত ১৪ হাজার ব্যক্তির মধ্যে ৬৩ শতাংশ তাদের এইচআইভি স্ট্যাটাস জানেন। যারা তাদের এইচআইভি আক্রান্ত হওয়ার তথ্য জানেন তাদের মধ্যে ৭৭ শতাংশ চিকিৎসাসেবার (এআরটি) আওতায় আছেন। যারা চিকিৎসা (অ্যান্টি রেট্রোভাইরাল থেরাপি) নিচ্ছেন তাদের ৯৩ শতাংশের ভাইরাল লোড নিয়ন্ত্রণে আছে।
ডা. খুরশীদ আলম আরো বলেন, গত এক বছরে যেসব গর্ভবতী মা এআরটি নিয়েছেন তাদের মধ্যে ৫৩ জন শিশু জন্ম দিয়েছেন। তাদের মধ্যে ৪৩ জন শিশু এইচআইভি নেগেটিভ। বাকি শিশুদের পরীক্ষা এখনো শেষ হয়নি। এইচআইভি পজিটিভ গর্ভবতী মা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে এআরটি গ্রহণ করলে এইচআইভি নেগেটিভ শিশু জন্ম দেওয়া সম্ভব বলে তিনি দাবি করেন।
এক প্রশ্নের জবাবে ডা. খুরশীদ আলম বলেন, পুলিশ ও কারাগারে অচিরেই এইচআইভি টেস্টিং কার্যক্রম শুরু হবে। ভবিষ্যতে এইচআইভি টেস্টিং কার্যক্রম সব মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল ও সব জেলা সদর হাসপাতালে চালু করা হবে। বিদেশফেরত বাংলাদেশিদের এইডস শনাক্তে পরীক্ষা-নিরীক্ষার বিষয়ে সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কোনো পরিষ্কার ধারণা ও যন্ত্রপাতি নেই এ প্রসঙ্গে ডা. খুরশীদ বলেন, প্রবাসীদের দেশে আসার পর দ্রুত সময়ের মধ্যে স্ক্রিনিংয়ের আওতায় আনার উদ্যোগ নেওয়া হবে।