আমরা উৎসবপ্রেমী বাঙালি। বাঙালি হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রধান ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গোৎসব। প্রতিবছরই এই দুর্গোৎসব ঘিরে মেতে ওঠে বাঙালিরা। ঢাকের বাদ্যের সঙ্গে উলুধ্বনি, শঙ্খনাদ আর কাসর ঘণ্টা বাজিয়ে ষষ্ঠীপূজার মধ্য দিয়ে বাঙালি হিন্দুদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজার আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয়। গতকাল সোমবার সকাল ৯টায় দেবীর ষষ্ঠাদি কল্পারম্ভে ষষ্ঠী পূজা শুরু হয়েছে। ষষ্ঠী তিথিতে বেলতলায় বিহিতপূজার পর দেবীর আমন্ত্রণ ও অধিবাসের মধ্য দিয়ে হয়েছে মূল দুর্গোৎসবের সূচনা। বিকালে সারা দেশে মণ্ডপে মণ্ডপে হবে দেবীর ঘুম ভাঙানোর বন্দনা পূজা বা বোধন। তারপর মাকে পূজা দিয়ে বরণ কওে সবাই মন্দিরে যাবে। হিন্দু বিশ্বাস অনুযায়ী, দশভূজা দেবী দুর্গা অসুর বধ করে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে প্রতি শরতে কৈলাস ছেড়ে কন্যারূপে মর্ত্যলোকে আসেন। সন্তানদের নিয়ে পক্ষকাল পিতার গৃহে কাটিয়ে আবার ফিরে যান দেবালয়ে। আশ্বিন শুক্লপক্ষের এই ১৫টি দিন দেবীপক্ষ, মর্ত্যলোকে উৎসব।
বিশুদ্ধ সিদ্ধান্ত পঞ্জিকা মতে শুক্রবার বিজয়া দশমীতে প্রতিমা বিসর্জনের মধ্য দিয়ে এবারের দুর্গোৎসবের শেষ হবে। একটি বছরের জন্য ‘দুর্গতিনাশিনী’ দেবী ফিরে যাবেন কৈলাসে দেবালয়ে।
সনাতন ধর্মাবলম্বীদের বিশ্বাস, ত্রেতাযুগে ভগবান রাম তার স্ত্রী সীতাকে উদ্ধার করতে দেবী দুর্গার অকালবোধন করেন। ব্রহ্মার নির্দেশ অনুযায়ী দুর্গার সাহায্যে রাবণ বধ করে সীতাকে উদ্ধার করেন তিনি। দেবীর সেই আগমণের সময়ই দুর্গোৎসব।
রাম শরৎকালে দেবীকে আহ্বান করেছিলেন বলে এ পূজা শারদীয় দুর্গা পূজা নামেও পরিচিত। আর মর্ত্যলোকে আসতে দেবীর সেই ঘুম ভাঙানোকে বলা বলা হয় অকাল বোধন। শাস্ত্র বলছে, রবৌ সোমে গজরূঢ়া, ঘোটকে শনি ভৌময়ৌঃ। দোলায়ঞ্চ গুরৌ শুক্রে, নৌকায়ং বুধবাসরে।
আমাদের যে কোনো উৎসব ধর্ম-বর্ণ-প্রথা ভেদাভেদ ভুলে পালন করতে জাতি হিসেবে বাঙালি এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। কোনো উৎসব সামনে পেলে এতে মেতে ওঠা বাঙালির এক অনন্য বৈশিষ্ট্য। হোক সেটি ধর্মীয় অনুষ্ঠান। বিশ্বাসের জায়গা আলাদা রেখে সবাই একে অন্যের আমন্ত্রণে ছুটে যান নির্দ্বিধায়। আহার গ্রহণ করেন, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উপভোগ করেন, সুখ-দুঃখের কথা বলেন ও প্রীতি বিনিময় করেন সাবলীলভাবে। বাংলার ষড়ঋতুর তৃতীয় ঋতু শরতের আশ্বিন মাসের শুক্লপক্ষে শারদীয় দুর্গাপূজা এবং ঋতুরাজ বসন্তের চৈত্র মাসের শুক্লপক্ষে বাসন্তী দুর্গাপূজা উদযাপনের প্রথা রয়েছে।
দুর্গাপূজা মানেই সর্বজনীন উৎসব, দেবী দুর্গা আমাদের মাঝে মাতৃরূপে বিরাজ করেন, সবার মা। মা সন্তানের সুরক্ষাদায়িনী, সব অপশক্তি বিনাশিনী, মুক্তিদায়িনী, আনন্দময়ী দুর্গা। মায়ের কাছে সব সন্তান সমান, সব সন্তানের কাছে মা অনন্য, তাই মা দুর্গা সর্বজনের, দুর্গাপূজা সর্বজনীন। হিন্দু পুরাণে আছে, ভগবান ব্রহ্মা মহিষাসুর দৈত্যের কিছু ভালো কর্মকাণ্ডে সন্তুষ্ট হয়ে বর দিতে চেয়েছিলেন, মহিষাসুর ‘অমর’ বর প্রার্থনা করেছিল, ব্রহ্মা সরাসরি অমরত্ব বর না দিয়ে বর দিলেন, বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের কোনো পুরুষের হাতে মহিষাসুরের মৃত্যু হবে না। ভগবান ব্রহ্মা, যিনি বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি করেছেন, তার কাছ থেকে এমন বর পেয়ে মহিষাসুর ধরাকে সরাজ্ঞান করতে আরম্ভ করে। সে ধরেই নিয়েছিল যেহেতু নারীরা শারীরিক দিক থেকে অত্যন্ত দুর্বল এবং কোনো পুরুষের হাতে তার মৃত্যু নেই, তাই সে হবে অপরাজেয়, অমর। তার খুব ইচ্ছা হলো স্বর্গ-মর্ত্য জয় করার, দেবতাদের ওপর অত্যাচার শুরু করে দিল, তার অত্যাচারে স্বর্গের দেবতারা অতিষ্ঠ হয়ে ওঠে। দেবরাজ ইন্দ্রকে পরাজিত করে মহিষাসুরের অত্যাচার দেবতাদের আয়ত্তের বাইরে চলে যায়। এভাবেই মহিষাসুর অপরাজেয় এবং অপ্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠে, এরপর সে স্বর্গের দেবতাদের স্বর্গ থেকে বিতাড়ন করতে শুরু করে।
অসুরের অত্যাচারে অতিষ্ঠ দেবতারা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করেন, তারা ব্রহ্মার দেওয়া কঠিন বরের ভেতরেই আলো দেখতে পান। ব্রহ্মা বর দেওয়ার সময় বলেছিলেন, কোনো পুরুষের হাতে মহিষাসুরের মৃত্যু হবে না, এখানে নারীর কথা উহ্য রাখা হয়েছে। তার মানে নারীর হাতে মহিষাসুরের পরাস্ত হওয়ায় কোনো বাধা নেই। তখন ‘ব্রহ্মা-বিষ্ণু-শিব’র আহ্বানে দশভুজা যে নারী মূর্তির আবির্ভাব হলো, তিনিই দেবী দুর্গা। যেহেতু মহাপরাক্রমশালী মহিষাসুরের সঙ্গে লড়তে হবে, দুই হাতে লড়াই করা সম্ভব নয় বলেই দেবী দুর্গাকে দশ ভুজারূপে কল্পনা করা হয়েছে। দুর্গা আবির্ভুত হওয়ার পর দুর্গার দশ হাত মারণাস্ত্র দিয়ে সুসজ্জিত করে দেওয়া হলো। শিব দিলেন ত্রিশূল, বিষ্ণু দিলেন চক্র, ইন্দ্র দিলেন তীর ধনুক, তরবারি, ঢাল, বিষধর সর্প, তীক্ষè কাঁটাওয়ালা শঙ্খ, বিদ্যুৎবাহী বজ্রশক্তি এবং একটি পদ্মফুল। দেবী দুর্গা এবং মহিষাসুরের মধ্যে দশ দিনব্যাপী মহাযুদ্ধ হয়েছিল, মহিষাসুরকে পরাস্ত করা রীতিমতো অসাধ্য হয়ে উঠেছিল, কারণ সে মায়ার খেলা জানত, দুর্গাকে বিভ্রান্ত করতে সে একেকবার একেক জন্তু-জানোয়ারের রূপ ধারণ করছিল, দেবী দুর্গার জন্য যুদ্ধ ভীষণ কঠিন হয়ে উঠে যখন অসুরের ক্ষতস্থান থেকে রক্তের ফোঁটা মাটিতে পড়া মাত্র সেখান থেকে একই চেহারার আরেকটি অসুর জন্ম নিচ্ছিল। এভাবে দুর্গার তরবারির কোপে রক্তাক্ত অসুরের প্রতি রক্তবিন্দু থেকে শত সহস্র অসুরের জন্ম হলো এবং দুর্গার দিকে ধেয়ে এলো। তখনই দেবী দুর্গা অন্য মূর্তি ধারণ করলেন, সে মূর্তির রূপ হলো আরো ভয়ঙ্কর, লম্বা জিভ, চার হস্ত কালী মূর্তি, যার প্রধান কাজই ছিল অসুরের রক্তবীজ মাটি স্পর্শ করার আগেই লম্বা জিভ বের করে চেটে খেয়ে ফেলা। এভাবেই রক্তবীজ থেকে অসুরের উৎপত্তি বন্ধ হয়ে গেল এবং যুদ্ধের দশম দিনে অসুর মহিষের রূপ নিয়েছিল, উপায়ান্তর না দেখে মহিষের দেহ থেকে বেরিয়ে এলো বিশালদেহী মানুষের রূপে, তখনই দেবী দুর্গার হাতের ত্রিশূল মহিষাসুরের বক্ষ্যভেদ করল। মহিষাসুরের মৃত্যুর মধ্য দিয়ে স্বর্গ, মর্ত্য, পাতালে শান্তি ফিরে এলো। স্বর্গের দেবতারা দেবী দুর্গার নামে জয়ধ্বনি করলেন।
শরৎকালে পূজা অনুষ্ঠিত হয় বলে দুর্গাপূজাকে ‘শারদীয় দুর্গোৎসব’ বলা হয়। মূল দুর্গাপূজা শুরু হয়েছিল বসন্তকালে, সেই পূজার আরেক নাম ‘বাসন্তী পূজা’। হিন্দু পুরাণে আছে, শরৎকালীন দুর্গাপূজার প্রচলন হয় রামায়ণ যুগ থেকে। রাক্ষসরাজ রাবণ শ্রীরামের স্ত্রী সীতাদেবীকে হরণ করে লঙ্কায় নিয়ে গেছিল, রাজা রাম স্ত্রী সীতাকে রাক্ষসরাজ রাবণের বন্দীশালা থেকে উদ্ধার করতে যাওয়ার আগে ‘দেবী চণ্ডি’রূপী দুর্গার পূজা করেছিলেন। ১০৮টি নীলপদ্ম এবং ১০৮টি প্রদীপ জ্বালিয়ে পূজা করেছিলেন। (রামায়ণে বর্ণিত আছে, ১০৭টি পদ্ম জোগাড় হয়েছিল, শ্রীরাম ছিলেন ‘নীলনয়ন’, উপায়ান্তর না দেখে শ্রীরাম নিজের একখানি চোখ দান করতে উদ্যত হয়েছিলেন, শ্রীরামের ভক্তিতে দেবী দুর্গা সন্তুষ্ট হয়ে স্বয়ং শ্রীরামকে চোখ দান করা থেকে নিবৃত্ত করেন।) বসন্তকালের পরিবর্তে শরৎকালে দুর্গাপূজা করেছিল বলেই এ পূজাকে অকালবোধন বলা হয়।
বাংলায় শারদীয় দুর্গোৎসব কবে, কোথায় সর্বপ্রথম আয়োজিত হয়েছিল, তার সঠিক উত্তর জানা নেই। ইতিহাসবিদরা মনে করেন, ১৫০০ শতকের শেষের দিকে মহাধুমধামের সঙ্গে শারদীয় দুর্গাপূজা শুরু হয়েছিল। ধীরে ধীরে নয়, দুর্গাপূজার এ সর্বজনীন আয়োজন খুব দ্রুত জনপ্রিয়তা অর্জন করে এবং একসময় ‘সর্বজনীন শারদীয় দুর্গোৎসব’ হিসেবে বাংলা সংস্কৃতির অংশ হয়ে ওঠে। দুর্গাপূজার মাধ্যমে বাংলা সংস্কৃতিতে নারীর ভূমিকাকে অত্যন্ত গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, দুর্গাকে মাতৃরূপে বর্ণনার মাধ্যমে প্রথমত নারীর চিরন্তন মাতৃরূপকে মূল্যায়ন করা হয়েছে, দুর্গা কর্তৃক মহিষাসুর বধের মাধ্যমে নারীকে মহাশক্তির আধার রূপে চিত্রিত করা হয়েছে। দুর্গাকে বলা হয়েছে সৃষ্টির প্রতীক, সমৃদ্ধির প্রতীক, সুরক্ষার প্রতীক, হিন্দু মিথলজিতে দুর্গার আদলেই নারীকে চিত্রিত করা হয়েছে। নারী সৃষ্টির প্রতীক, নারী সন্তান জন্ম দেয়, সন্তানের মুখে আহার তুলে দেয়, সন্তানকে প্রতিকূলতা থেকে সুরক্ষা করে, নারী সংসার গড়ে, সমাজ গড়ে, সমাজ-সংসারকে সব বিপদ-আপদ থেকে রক্ষাও করে, নারী বিপন্নকে আশ্রয় দেয়, নিরন্নকে অন্ন দান করে, এভাবেই নারী হয়ে ওঠে দুর্গার প্রতিমূর্তি।
বছরে দুইবার দুর্গোৎসবের প্রথা থাকলেও বাংলাদেশে শরৎকালীন (শারদীয়) দুর্গোৎসবই বেশি উদযাপিত হয়ে থাকে। ১০ দিনব্যাপী এ উৎসবে ছোট-বড় সবাই উল্লাসের সঙ্গে অংশগ্রহণ করে থাকেন। সপ্তমী থেকে নবমী পূজা হচ্ছে মাতৃপূজা বন্দনার মূল পর্ব হিসেবে স্বীকৃত। বিজয়া দশমীতে বিসর্জনের মাধ্যমে শারদীয় দুর্গাপূজার পরিসমাপ্তি হয়। এ ছাড়া বিবিধ মাঙ্গলিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে প্রতিদিনের পূজা ভোর থেকে শুরু হয়ে মধ্যরাত পর্যন্ত চলমান থাকে। প্রতিদিন রাতকালীন আরতি দেওয়ার মাধ্যমে পূজার সমাপ্তি ঘটে। কিন্তু পরিতাপের বিষয়- যেসব সনাতনী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছাড়া অন্যান্য প্রতিষ্ঠানে চাকরি করে থাকেন, তারা পূজার ছুটি ভোগ করেন শুধু একদিন। সেটি বিজয়া দশমীর ছুটি হিসেবে স্বীকৃত। দুঃখের বিষয়, সপ্তমী থেকে নবমী পূজায় সব অফিস খোলা থাকায় দেশের লাখো সনাতনী সম্প্রদায় পূজায় উপস্থিত থেকে ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালন করতে ব্যর্থ হন। চাকরিজীবী অনেকের সমস্যা সৃষ্টি হয়। পরিবারের সঙ্গে উৎসব আনন্দ ভাগাভাগি করতে ছন্দপতন হয়ে যায়। শারদীয় দুর্গাপূজার উৎসব বছর পেরিয়ে শুধু একবারই আসে। তাই দেশের সব সনাতনী একসঙ্গে পূজামণ্ডপে উপস্থিত থেকে পূজার মাঙ্গলিক অনুষ্ঠান উদযাপন করতে ইচ্ছুক। আমরা সনাতন সম্প্রদায়ের প্রত্যেকেই প্রধানমন্ত্রীর কাছে অনুরোধ জানাব, আমাদের আবেদনের প্রতি দৃষ্টি দিন। আপনি চাইলে এই বছর থেকে ওই যৌক্তিক ছুটি বৃদ্ধি করতে পারেন। আমাদের অনুরোধ শারদীয় দুর্গাপূজায় অন্তত সপ্তমী, অষ্টমী ও নবমী পূজার তিন দিনের সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হোক। সবাই মিলে দুর্গা উৎসব পালন করি। পরম আকুলতায় বলি ‘ধর্ম যার যার উৎসব সবার’।
লেখক : সাহিত্যিক।
আজকালের খবর/আরইউ