দেশে নিত্যনতুন অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটছে। কখনও কারখানায় কখনও বস্তিতে কখনও-বা বন্ধ গোডাউনে। পাল্লা দিয়ে নিয়ম ভাঙা হচ্ছে। দেশে বিল্ডিং কোড আছে, কারখানা আইন ও শ্রম আইন রয়েছে। কিন্তু এসব আইনের তোয়াক্কা না করে কারখানা চালানোর ফলেই প্রতিনিয়ত বিভিন্ন ধরনের দুর্ঘটনা ঘটছে। প্রাণহানির সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে। নারায়ণগঞ্জের জুস কারখানার ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা আমাদের সবাইকে নতুন করে কিছু দুর্ঘটনা বা অগ্নিকাণ্ডের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
ঢাকা মহানগরীর উপকণ্ঠ আশুলিয়ার নিশ্চিন্তপুর এলাকায় অবস্থিত তাজরীন ফ্যাশনস লিমিটেড কারখানায় ২০১২ সালের ২৪ নভেম্বর সংঘটিত একটি মারাত্মক অগ্নিকাণ্ড ঘটে যাতে মোট ১১৭ জন পোশাকশ্রমিক নিহত হন ও ২০০ জনের অধিক আহত হন। ভয়ানক এই দুর্ঘটনায় ওই পোশাক কারখানার নয়তলা ভবনের ছয়তলা ভস্মীভূত হয়ে যায়। সরাসরি আগুনে দগ্ধ হয়ে মারা যায় ১০১ জন পোশাকশ্রমিক ও আগুন থেকে রেহাই পেতে ওপর থেকে লাফিয়ে পড়ে মৃত্যু হয় আরো ১০ জনের।
বৈদ্যুতিক শর্টসার্কিট থেকে আগুনের সূত্রপাত হয় বলে ধারণা করা হয়। নয়তলা ভবনের নিচতলায় আগুন লেগে মুহূর্তেই আগুনের ধোঁয়া ও শিখা সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠে যায়। যার কারণে ভবনের উপরের তলার শ্রমিকরা আটকা পড়ে যান। কারখানার বৃহৎ পরিমাণে ফ্যাব্রিক এবং সুতা থাকার কারণে, আগুন দ্রুত অন্যান্য তলায় ছড়িয়ে পড়ে, যা অগ্নিনির্বাপকের কাজকে জটিল করে। পরদিন রবিবার ভোর সাড়ে ৫টার দিকে আগুন নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়। সে সময় নয়তলা ভবনের তৃতীয় তলা থেকে সবচেয়ে বেশি ৬৯টি লাশ উদ্ধার করা হয়, চতুর্থ তলায় ২১টি এবং পঞ্চমতলা থেকে ১০টি পোড়া মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। পরবর্তী সময়ে জানা যায় যে, অনেক শ্রমিক ভবনের সংকীর্ণ প্রস্থানের পথ দিয়ে নিচে নামতে পারছিলেন না। প্রাণে বাঁচতে লাফিয়ে পড়ে মারা যান বারো জন শ্রমিক, যাদের মধ্যে কয়েকজনকে আহত অবস্থায় হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর মারা যান। কিছু শ্রমিক ভবনটির ছাদে উঠতে সক্ষম হয়েছিলেন যাদের পরে সফলভাবে উদ্ধার করা হয়।
দমকল বাহিনীর ভাষ্যমতে, কারখানাটিতে পর্যাপ্ত জরুরি প্রস্থানের ব্যবস্থা না থাকার ফলে ভবন থেকে দ্রুত নামা সম্ভবপর ছিল না। বিশাল ভবনে তিনটি সিঁড়ি ছিল, যেগুলোর সবগুলো নিচতলায় এসে মিলিত হয়। নিচতলায় আগুন লাগার কারণে এগুলো ব্যবহার করা অত্যন্ত বিপজ্জনক এবং অব্যবহারযোগ্য হয়ে উঠেছিল। এতে অনেক শ্রমিক আটকা পড়েন এবং আগুন থেকে নিজেকে রক্ষা করে বাইরে বেরিয়ে আসতে পারেননি।
এদিকে ২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল সকাল ৮টা ৪৫ মিনিটে সাভার বাসস্ট্যান্ডের পাশে রানা প্লাজা নামের একটি বহুতল ভবন ধসে পড়ে। ভবনের কয়েকটি তলা নিচে দেবে যায়। কিছু অংশ পাশের একটি ভবনের ওপর হেলে পড়ে। এ দূর্ঘটনায় এক হাজার ১৩৪ জন শ্রমিক নিহত এবং প্রায় আড়াই হাজারের মত মানুষ আহত হন, যা বিশ্বের ইতিহাসে তৃতীয় বৃহত্তম শিল্প দুর্ঘটনা হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে। আজও এ ঘটনার সুরাহা হয়নি। হাজার হাজার আহত শ্রমিকরা এখনো তাদের প্রকৃত ক্ষতিপূরণ পাননি।
এদিকে, ২০১৯ সালের ২৮ মার্চ দুপুর ১টায় ঢাকার বনানীর বহুতল বাণ্যিজিক ভবন এফআর টাওয়ারে অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হয়। ২২ তলা ভবনের অষ্টম তলা থেকে আগুনের সূত্রপাত হয় ও ক্রমেই তা অন্যান্য তলায় ছড়িয়ে পড়ে। অগ্নিকাণ্ডে ২৬ জনের মৃত্যু হয় এবং ৭০ জন আহত হন। পড়ে জানা যায় ভবনটি বিল্ডিং কোড ভঙ্গ করে নির্মাণ করা হয়েছিল এবং ভবনে যথেষ্ট পরিমাণে অগ্নিনির্বাপক সুবিধা ছিল না। অথচ বনানীর মতো অভিজাত এলাকায় ভবন নির্মাণে রাজউকের অনোমোদন ও তদারকি বাধ্যতামূলক ছিল। দেশে আইন ভঙ্গ করার এক ভয়াবহ সংস্কৃতি তৈরি হয়েছে। ফলে নিত্যনতুন দুর্ঘটনা ঘটছে।
এরও আগে ২০১০ সালের ৩ জুন পুরান ঢাকার নবাব কাটরার নিমতলী মহল্লায় একটি বড়সড় অগ্নিকাণ্ড সংঘটিত হয় যা নিম্নতলি অগ্নিকাণ্ড বা নিমতলী ট্র্যাজেডি নামে পরিচিত। এই অগ্নিকাণ্ডে ১১৯ জন মানুষ নিহত হন। বহুমানুষ আহত হন। তখনো সরু গলিপথের কারণে সময়মত অগ্নিনির্বাপণ করা যায়নি। সরকারি আইন অনুযায়ী আবাসিক এলকায় দাহ্য পদার্থ মজুত করার কোনো সুযোগ না না সত্ত্বেও কি করে দিনের পর দিন নিমতলীতে অবৈধ ব্যবসা চললো তা কিন্তু আমাদের মতো সাধারণ মানুষের পক্ষে জানা সম্ভব না হলেও বিস্ফোরক দ্রব্য অধিদপ্তরের কর্তাব্যক্তিদের না জানার কথা নয়।
সম্প্রতি ঢাকার মগবাজারে একটি ভবনে ভয়াবহ বিস্ফোরণে অন্তত ছয়জন নিহত হয়েছেন। ওই ঘটনায় শতাধিক মানুষ আহত হয়েছে এবং আশপাশের দুই শতাধিক ভবন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। দেশে এসব দেখভাল করার জন্য আইনানুগ কর্তৃপক্ষ রয়েছে। তাহলে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন আসে তাহলে কি তারা তাদের দায়িত্ব পালনে গাফলতি করেছিলেন?
নারায়ণগঞ্জের অগ্নিকাণ্ড যেন আরেক নিমতলী বা তাজরীন গার্মেন্টস ট্র্যাজেডির সমতুল্য। রূপগঞ্জের সেজান জুস কারখানা মানুষের পোড়া লাশের সারি আর স্বজনদের আহাজারিতে ভারী হয়ে উঠেছে। অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় এই কারখানার ভেতর থেকে এখন পর্যন্ত ৫২ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। ফায়ার সার্ভিসের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, কারখানা ভবনের উপরের তলায় প্লাস্টিকসহ দাহ্য পদার্থ থাকায় ১৮টি ইউনিট দিয়েও আগুন নেভাতে বেগ পেতে হয়। আগুন লাগার কারণ অনুসন্ধানে গঠন করা হয়েছে তদন্ত কমিটি।
কারখানা ভবনে আগুনের সূত্রপাত বৃহস্পতিবার বিকেলে। খবর পেয়ে তা নেভাতে যায় ফায়ার সার্ভিস। একে একে যোগ দেয় ১৮টি ইউনিট। কিন্তু আগুনের ভয়াবহতা এতটাই তীব্র ছিল যে, তা রাতভর চেষ্টা চালিয়ে নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হয়নি। এরই মধ্যে ভবন থেকে লাফিয়ে পড়ে দু’জনের মৃত্যু হয়। শুক্রবার দুপুরেও ভবনের চতুর্থ, পঞ্চম ও ষষ্ঠ তলায় আগুন জলতে দেখা যায়। তবে তৃতীয় তলা পর্যন্ত আগুন নিয়ন্ত্রণে আসায় ভেতরে তল্লাশি চালান ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা। এরপরই একে একে উদ্ধার করা হয় পুড়ে কঙ্কাল হয়ে যাওয়া মরদেহ। দমকল কর্মকর্তারা জানান, কারখানা ভবনের উপরের তলাগুলোয় প্লাস্টিকসহ বিপুল পরিমাণ দাহ্য পদার্থের মজুত ছিল। ভবন থেকে ছাদে ওঠা এবং বের হওয়ার দরজা ছিল তালাবদ্ধ। এছাড়া বিভিন্ন সময় বস্তিতে আগুন যেন দেশে নিত্যনৈমত্তিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। দেশে কারখানা আইন বিদ্যমান। কারখানা পরিদর্শক আছে। এসব কারখানা দেখভাল করার জন্য যথাযথ কর্তৃপক্ষও রয়েছে। দেশের প্রতিটি কারখানায় শ্রমিক স্বার্থ ও শ্রমিকদের কল্যাণ নিশ্চিতে দেশে শ্রম আইন বিদ্যমান। দেশে এখনো অনেক কারখানা আবাসিক ভবনে বা বাসা বাড়িতে তাদের উৎপাদন কার্য পরিচালনা করে চলেছে। কারখানা আইনানুসারে তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। সকল অগ্নিকাণ্ডের পরম্পরা প্রায় এক ও অভিন্ন। পর্যাপ্ত বহিঃনির্গমন পথের অভাব, ভবনের মূল গেটে তালা, অগ্নিনির্বাপক যন্ত্রপাতির অনুপস্থিতি হেলথ ও হাইজিনের অপর্যাপ্ততা বহুলাংশে দায়ী। অথচ দেশে পর্যাপ্ত আইন রয়েছে, সঠিক তদারকি করার জন্য যথাযথ কর্তৃপক্ষ ও বিধানাবলী রয়েছে, অগ্নিনির্বাপক অধিদপ্তর রয়েছে, বিল্ডিং কোড রয়েছে। বিস্ফোরণ দ্রব্য অধিদপ্তর রয়েছে। তাহলে এতসব কর্তৃপক্ষের চোখ ফাঁকি দিয়ে দিনের পর দিন কিভাবে অনিয়ম করা সম্ভব সেটাই আজ বড় প্রশ্ন। প্রতিটি বড় ঘটনার পরেই একাধিক তদন্ত কমিটি গঠিত হয়, মামলা হয়, নিহত ও আহত অসহায় শ্রমিক পরিবারকে নামমাত্র আর্থিক সহায়তা করা হয়। কিন্তু অপকর্মের সঙ্গে জড়িত রাঘববোয়ালরা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ধরা-ছোঁয়ার বাইরে থেকে যায়। দেশে কার্যকর কারখানা আইন অনুযায়ী এমন ঝুঁকিপূর্ণ ভবনে উৎপাদনমুখী শিল্পের অনুমোদন পাওয়ার কথা নয়। তাহলে কিভাবে কার মদদে এসব কারখানার মালিকরা আইন-কানুনকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে দেশে বিদেশে দেশের ভাবমূর্তিকে ক্ষুণ্ন করছে। আর কত শ্রমিক আগুনে পুড়ে মারা গেলে দেশে শ্রমিক স্বার্থ সুরক্ষা নিশ্চিত হবে সেটাই আজ বড় প্রশ্ন। আর তদন্ত কমিটি নয়। কথার কথা নয়। কারখানা আইন ও শ্রম আইনের নিরপেক্ষ প্রয়োগই পারে এমনতর ভয়াবহ দুর্ঘটনা রোধ করতে।