শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪
উন্নয়নের নামে বৃক্ষ নিধন বন্ধ করুন
ফারিয়া ইয়াসমিন
প্রকাশ: সোমবার, ১০ মে, ২০২১, ৭:৫৬ PM
পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় অন্যতম প্রধান ভূমিকা রাখে গাছপালা। একটা দিককে এগিয়ে নিতে গেলে অন্যদিকে পেছনে ফেলতে হয়। ঠিক তেমনি কোনো কিছুর উন্নতি করতে গেলে অপর একটা জিনিসের ক্ষতি হবে এটাই স্বাভাবিক তবে ক্ষতিটা যদি এমন কোন প্রয়োজনীয় উপাদানের হয় যে তার সাথে সরাসরি যুক্ত আছে আমাদের মনুষ্যজাতির অস্তিত্ব তাহলে সেই উন্নয়ন স্থবির করাই শ্রেয়। বৃক্ষনিধন আমাদের দেশে নতুন কোনো বিষয় নয়, প্রতিনিয়ত মানুষ বন উজাড় করে চলেছে।  কেউ সচেতন নয় বন উজাড় করনের ভয়াবহ পরিণতি নিয়ে। দিগন্ত জুড়ে সবুজের সমারোহ এখন আর চোখে পড়ে না তেমন।  বৃক্ষ নিধন করে সভ্য নগর পরিকল্পনার নামে গড়ে উঠছে বড় বড় অট্টালিকা । 
প্রশ্ন হলো উন্নয়নের নামে কেন গাছ কাটা হবে? পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত হলে দায় কার? বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বিভিন্ন দিক থেকে এগিয়ে যাচ্ছে আর অন্যদিকে পরিবেশ রক্ষা সূচকে বাংলাদেশের অবস্থান ভয়াবহ খারাপ।  পূর্বের কিছু সমীক্ষা বিবেচনা করলেই তা বোঝা যায়। ২০১৯ সালের তালিকায় পরিবেশ রক্ষার বিভিন্ন সূচকে বাংলাদেশের গড় স্কোর ২৯.৫৫। ২০১৬ সালের তালিকায় বাংলাদেশের স্কোর ছিল ৪১.৭৬। প্রায় দ্বিগুণ আকারে নিচে নামছি আমরা। ২০১৪ সালের তালিকায় ১৭৮ টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৬৯।
জলবায়ু পরিবর্তনে অন্যতম ক্ষতিগ্রস্ত দেশ হয়েও সুন্দরবনের সন্নিকটে এবং পরিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকায় পরিবেশ বিধ্বংসী কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনে নির্ভরশীলতা অব্যাহত রাখার মাধ্যমে প্রাকৃতিক সম্পদ সুরক্ষা ও বন সংরক্ষণের বিপরীত নীতি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। সরকার ২০৫০ সালের মধ্যে কার্বন নির্গমন ৮০ শতাংশ হ্রাসের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করলেও বন নিধনের চিত্র এখনো কমেনি।
বিভিন্ন উছিলায় ধ্বংস করা হচ্ছে আমাদের বনভূমি। বিশ্বের সবচেয়ে বড় মনোগ্রাভ বন সুন্দরবনকে ঘিরে ফেলা হয়েছে বিভিন্ন কোম্পানি দিয়ে। যেখানে এই বনকে সুরক্ষা বেষ্টনি দিয়ে ঘিরে রাখা উচিত সেখানে উল্টো বিভিন্ন কারখানা বসছে এর চারিদিকে।  সুন্দরবনের কাছে গড়ে তোলা হচ্ছে বিশ্বের সবচেয়ে দূষিত হিসেবে স্বীকৃত কয়লাভিত্তিক তাপ বিদ্যুত কারখানা প্রকল্প। এভাবেই প্রতিটি জায়গায় সবুজের সমারোহ বিনষ্ট হয়ে যাচ্ছে । উন্নয়নের নামে চাপা পড়ে যাচ্ছে অপরাধীর নামগুলো। জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার হিসাবে বাংলাদেশ বার্ষিক বন উজাড় হওয়ার হার বৈশ্বিক গড়ের প্রায় দ্বিগুণ। গত সতেরো বছরে বাংলাদেশ প্রায়  ৬৬ বর্গ কিলোমিটার গ্রীষ্মমণ্ডলীয় রেইন ফরেস্ট ধ্বংস করা হয়েছে । পরিবেশ  রক্ষায় দেশের এমন খারাপ  অবস্থানের  কথা চিন্তা করেও আমরা সচেতন হই না।  আমরা এখনো সুযোগ পেলেই বৃক্ষনিধনে একত্রিত হয়ে যায়। 
পরিস্থিতি এখন এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, এক  অঞ্চলের গাছ কাটা রোধ করতে করতে অন্য কয়েক অঞ্চল মরুভূমির ন্যায় পতিত হচ্ছে। এগুলো নিয়ে প্রশ্ন উঠলেই তখন উন্নয়নের কথা বলা হয়। আসলে উন্নয়ন হচ্ছে নাকি উন্নয়নের নামে অজুহাত দিয়ে এসব বৃক্ষ নিধন পরিকল্পনা চলছে? 
সাম্প্রতিক একটা ঘটনা হলো সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বৃক্ষনিধন। গাছপালায় ঘেরা সোহরাওয়ার্দী উদ্যান যানজট শহরে এক প্রকার প্রাণস্বরূপ।  কিন্তু সেখানে গাছ কেটে উন্নয়নের নামে প্রাণহীন করে দেয়া হচ্ছে এই উদ্যানকে। এই উদ্যানে অবসর সময় কাটাতে আসে হাজার হাজার মানুষ। সেই সবুজের সমারোহ নষ্ট করতে ব্যস্ত সুযোগসন্ধানী কিছু মানুষ। 
উদ্যানটিতে প্রবেশ করলেই আগে চোখে পড়তো গাছগুলোর সৌন্দর্য আর এখন উদ্যানটিতে ঢুকলেই দেখা মেলে মাটি আঁকড়ে পড়ে থাকা কাটা গাছের গুঁড়ি আর কাটার জন্য চিহ্নিত করা গগণচুম্বী সব গাছ। গত ১০-১৫ দিনে গণপূর্ত অধিদফতরের আওতায় এখানকার প্রায় শতাধিক গাছ কাটা হয়েছে বলে জানালেন প্রত্যক্ষদর্শীরা।
রেস্টুরেন্টের স্থাপনার পাশাপাশি ওয়াকওয়ে তৈরির জন্যও চলছে মাটি খোঁড়াখুঁড়ি। এটি করতেও কাটা পড়ছে শতাধিক গাছ। উদ্যানের বিভিন্ন স্পটে পড়ে থাকা বড় বড় গাছের গুড়ি গুলো জানান দেয় কিছু সুবিধাভোগী মানুষের কথা যারা উন্নয়নের নামে এমন বৃক্ষনিধন বহুকাল ধরে করে আসছে।
এমন ঘটনা যে শুধু সোহরাওয়ার্দী উদ্যানেই ঘটছে তা নয় পুরো দেশেই গাছ কেটে চলছে নির্মাণ কাজ। আর এই কাজের জন্য সবচেয়ে যুক্তিযুক্ত অজুহাত দেওয়া হচ্ছে উন্নয়নের কথা বলে, যেখানে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মানুষের জীবন। পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হলে তার প্রভাব সবকিছুর উপরে পড়বে কিন্তু এ কথা বিবেচনা না করে বন উজাড় করে নিত্য নতুন ভাবে তৈরি করা হচ্ছে অবকাঠামো।  এ নিয়ে সরকারের নানান নির্দেশনা আছে,  আছে পরিবেশ আইন। কিন্তু তারপরও থেমে নেই কিছু, বৃক্ষ নিধন চলছেই। অপরাধকে আইনি খাতায়  নিয়মের বেড়াজালে  ফেলে বেঁচে যাচ্ছে এসব অপরাধীরা। 
বৃক্ষনিধনের সাথে জড়িত অপরাধী নয় সাথে আমরাও চোখ বন্ধ করে  অপরাধী কে প্রশ্রয় দিয়ে যাচ্ছি। কিছুদিনের জন্য প্রতিবাদে গর্জে ওঠে পুরো শহর আবার শান্ত হয়ে যায় আগের মত। এইসবের মাঝেই পরিবেশ তার ভারসাম্য হারাচ্ছে। নতুন করে বৃক্ষরোপণের চিন্তা না থাকলেও প্রতিনিয়ত গাছ কেটে ব্যবসায়ীক কাজে লাভবান হওয়ার চিন্তা সকলের মাথাতে আছে।
যদিও এরই মধ্যে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের গাছ কেটে ফেলার প্রতিবাদে পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো সোচ্চার হয়েছে। কিন্তু গাছ কাটা বন্ধ হয়নি। নতুন করে আরও অনেক গাছের গায়ে ‘লাল চিহ্ন’ দেওয়া হয়েছে, যেগুলোও কাটা হবে বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। উদ্যানের সবগুলো প্রবেশপথে বিভিন্ন স্থানে অন্তত সাতটি রেস্টুরেন্ট স্থাপন করার কাজ শুরু করেছে গণপূর্ত বিভাগ।
যে গাছগুলো কেটে ফেলা হয়েছে সেগুলো ৫০ বছরের পুরাতন গাছ।  সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের একপ্রকার ঐতিহ্য বহন করে আসছে এই গাছগুলো। বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত রয়েছে এই সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে। বহুকাল ধরেই কিছু  দুষ্টচক্রের নজর রয়েছে। এই উদ্যানের প্রতি আর আজ সামান্য খাবারের দোকানের জন্য এবং হাঁটার পথ তৈরি করার জন্য অবিবেচকের মতো গাছ কেটে ফেলা হচ্ছে। 
সোহরাওয়ার্দী উদ্যান রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ( কেআইপি) এলাকা হিসেবে চিহ্নিত। সেখানে রেস্টুরেন্টের মতো অপ্রয়োজনীয় নির্মাণের জন্য এত প্রাচীন গাছ কেন কাটা হবে? বাস্তুসংস্থানকে হুমকির মুখে ফেলে খাবারের দোকান দেওয়া নিতান্তই নির্বুদ্ধিতার পরিচয়। দ্রুত এই রেস্টুরেন্ট নির্মাণ কাজ বন্ধ করে বাকি গাছগুলোকে বাঁচাতে উদ্যোগ নিতে হবে। উন্নয়নের নামে এই বৃক্ষ নিধন মেনে নিলে ভবিষ্যতে বিপর্যয় নেমে আসবে।  আগে পরিবেশ সুরক্ষা নিশ্চিত করন প্রয়োজন তারপর অবকাঠামো নির্মাণ।  পরিবেশ সুরক্ষিত না করে কোন উন্নয়ন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা যায় না। তাই আমাদের প্রতিবাদ শুধু বৃক্ষনিধনের জন্য না হয়ে বৃক্ষ রোপনেও উদ্যোগী হতে হবে।
লেখক: শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট 
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়

আজকালের খবর/টিআর











সর্বশেষ সংবাদ
নতুন জাত ও প্রযুক্তি উদ্ভাবনে বিজ্ঞানী ও কৃষি শ্রমিকদের অবদান রয়েছে: কৃষিমন্ত্রী
ভোটের প্রচারণায় এগিয়ে মনোজ বৈদ্য
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রয়োগে সমতা চায় টিআইবি
স্বাগতম ২০২২, বিদায় ২০২১
প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপরূপ লীলাভূমি সুন্দরবন
আরো খবর ⇒
সর্বাধিক পঠিত
সুবাহর শরীরে নির্যাতনের চিহ্ন
তাদের মাখো মাখো ‘প্রেমের প্রাসাদ’!
‘আমাকে জায়গা দিন, এটা আমার প্রাপ্য’ : লালকেল্লার দাবিদার মোগল সম্রাজ্ঞী
চা দোকানিকে পিটিয়ে ও শ্বাসরোধে হত্যা
ভোটের প্রচারণায় এগিয়ে মনোজ বৈদ্য
Follow Us
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি : গোলাম মোস্তফা || সম্পাদক : ফারুক আহমেদ তালুকদার
সম্পাদকীয়, বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : হাউস নং ৩৯ (৫ম তলা), রোড নং ১৭/এ, ব্লক: ই, বনানী, ঢাকা-১২১৩।
ফোন: +৮৮-০২-৪৮৮১১৮৩১-৪, বিজ্ঞাপন : ০১৭০৯৯৯৭৪৯৯, সার্কুলেশন : ০১৭০৯৯৯৭৪৯৮, ই-মেইল : বার্তা বিভাগ- newsajkalerkhobor@gmail.com বিজ্ঞাপন- addajkalerkhobor@gmail.com
কপিরাইট © আজকালের খবর সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত | Developed By: i2soft